শরীয়তপুর জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হাজী শরীয়তউল্লাহর ফরায়েজি
আন্দোলন
মোঃ মাসুদ রানা
শরীয়তপুর জেলা ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি জেলা। অনেক মনীষী নানাভাবে এই জেলার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁদের অবদান দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। জেলা হিসেবে শরীয়তপুর বেশি পুরাতন না হলেও এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় হাজী শরীয়তউল্লাহর নামটি অনিবার্যভাবে আসে। এই অঞ্চলের প্রতি অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর নামানুসারে জেলার নামকরণ করা হয়েছে। তাঁকে ছাড়া শরীয়তপুর জেলার ইতিহাস অসম্পূর্ণ।
শরীয়তপুর জেলা বিক্রমপুর পরগণার দক্ষিণাঞ্চল এবং চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের উত্তরাঞ্চল ইদিলপুর পরগনার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত। এর ৬টি থানা ছিল ফরিদপুর জেলা ও মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত। মাদারীপুর জেলা একসময় ছিল চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের ও বাকেরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত। তারপর এটি ফতেহাবাদ বা ফরিদপুরের অন্তর্গত হয়। মাদারীপুর জেলার অধিবাসী ফরায়েজি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হাজী শরীয়তউল্লাহর (১৭৮১-১৮৪০) নামানুসারে ‘শরীয়তপুর’ নামে নতুন একটি মহকুমা গঠিত হয় ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর। জেলা হিসেবে শরীয়তপুরে অগ্রযাত্রা শুরু হয় ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ। শরীয়তপুর নামে কোনো স্থান না থাকলেও প্রথমে মহকুমা ও পরে জেলার নাম হয় শরীয়তপুর। জেলা সদরের পূর্বতন নাম পালং। এটি খুবই প্রাচীন জনপদ। ১৮১১ সালে ফরিদপুরে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজস্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময়ে পালং থানা গঠিত হয়। তখন বাকেরগঞ্জ জেলার গৌরনদী থানা, ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানা ও মানিকগঞ্জ মহকুমা ফরিদপুরের অন্তর্গত ছিল। ১৮৭৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘ক্যালকাটা গেজেট’ থেকে মাদারীপুর মহকুমার থানা হিসেবে মাদারীপুর, পালং, ডামুড্যা, গোসাইরহাট ও শিবচর থানার নাম পাওয়া যায়। এই থানাগুলোর মুন্সেফি ছিল চিকন্দিতে। আর সকল থানায় সাবরেজিস্টারের কার্যালয়ও ছিল। ১৮৮১ সালের ৯ মার্চ কলকাতা গেজেটে পালং থানার সীমানা নির্ধারণ করার আগেই এটি থানা হিসেবে চালু ছিল।
বাংলাদেশের একটি জেলা হিসেবে এটি নবীন। ১৯৮৪ সালে এর গঠন হলেও জনপদ হিসেবে এর প্রাচীনতা অস্বীকার করার উপায় নেই। দিকালে এটি ছিল ‘বঙ্গ’ (Vanga) রাজ্যের অধীন। ‘বঙ্গ’ রাজ্য বিস্তৃত ছিল পদ্মানদীর দক্ষিণ পাশের অঞ্চলে। ইংরেজি উচ্চারণ লক্ষ করলে ফরিদপুর জেলার ‘ভাঙ্গা’ থানার নামটি ‘বঙ্গ’ শব্দের অপভ্রংশ বলে মেনে নেওয়া যায়। এই অঞ্চলের ৪র্থ শতকের আগের ইতিহাস জানা যায়নি। ৪র্থ শতকে এই অঞ্চল ছিল গুপ্ত রাজবংশের অধীনে। ৬ষ্ঠ শতকে ধর্মাদিত্য নামক এক রাজার শাসনে ছিল। বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত তাম্রশাসন থেকে শাসনকর্তা হিসেবে রাজা গোপালের নামও জানা যায়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর সমাচার দেব নামক একজন স্বাধীন রাজা এ-অঞ্চলে শাসন করেন (৬১৫-৬২০)। ৭ম শতকে বঙ্গ অঞ্চল থাকে রাজা হর্ষবর্ধনের অধীনে। তাঁর মৃত্যুর (৬৪৭) পরে বঙ্গ রাজ্য বিভক্ত হয়ে পড়ে। তখনকার শাসকের নাম যথাযথভাবে জানা যায়নি। তবে এটি পরে ‘খাদগাস’ রাজতন্ত্রের অধীনে (৬৫০-৭০০) ছিল। ১০ম ও ১১শ শতকে বৌদ্ধ রাজাদের অধীনে যায়। এর পর বর্মণ, পাল ও সেন বংশের শাসন চলে। ১২০৬ সাল পর্যন্ত রাজা ছিলেন লক্ষণ সেন। তাঁর পুত্র বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেন ১২০৬ থেকে ১২২২ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চল শাসন করেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে সেন রাজাগণ এই অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা হারান। ঐ সময় দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার শাসক দেব রাজবংশের প্রতিনিধি দশরথ দেব এই অঞ্চলের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। দশরথ দেব-ই এই অঞ্চলের শেষ হিন্দু রাজা।
এরপর চতুর্দশ শতক থেকে ১৫৭৫ সাল পর্যন্ত মুসলিমদের শাসন চলে। ১৩৩০ সালে মুহম্মদ বিন তুগলক পূর্ববঙ্গ দখল করে লখনৌতি, সাতগাঁও ও সোনারগাঁও নামে তিনটি প্রদেশে ভাগ করেন। সোনারগাঁও-এর গভর্নর ছিলেন তাতার বাহরাম খান। ১৩৩৮ সালে বাহরাম খানের মৃত্যুর পর তাঁরই অস্ত্রবাহী ফখরুদ্দিন শাহ ক্ষমতা দখল করেন এবং মুবারক শাহ উপাধি নিয়ে দশ বছর শাসন করেন। ১৩৫১ সালে সামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ এবং পরে তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ এবং তাঁর পুত্র আজম শাহ এই অঞ্চল শাসন করেন। পরে রাজা খান এই অঞ্চল দখল করেন। ১৪৪৫ সালের দিকে ইলিয়াস শাহের বংশধর মাহমুদ শাহ (প্রথম) বঙ্গ একীভূত করে ১৪৮৭ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। এই সময় ঢাকা, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ অঞ্চল নিয়ে জালালাবাদ এবং ফতেহবাদ প্রদেশ গঠন করা হয়। ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ সাল পর্যন্ত এ এলাকা শাসন করেন হোসেন শাহ। তিনি প্রথমে ফতেহবাদের ক্ষমতা দখল করেন এবং সেখানে তার প্রথম মুদ্রা ছাপানো হয়। লখনৌতি প্রদেশের শাসক জালালউদ্দিন ফতেহশাহর নামানুসারে এই ফতেহাবাদ পরে ফরিদপুর নামে রূপান্তরিত হয়। মুঘলদের আমলে (১৫৭৬-১৭৫৭) সম্রাট আকবরের নির্দেশে ১৫৭৪ সালে মুরাদ খান নামে এক সেনাপতি ফতেহবাদ (ফরিদপুর) ও বাকেরগঞ্জ দখল করেন। মুরাদ খান এরপর ফরিদপুরেই থেকে যান এবং ছয় বছর পরে মারা যান। শরীয়তপুর-এর নড়িয়া থানার কেদারপুর নামক স্থানে আগে বারো ভূইয়াদের দুই জন ভূঁইয়া চাঁদরায় ও কেদাররায় এ-অঞ্চলের শাসক ছিলেন। কেদাররায় মানসিংহের সেনাপতির সঙ্গে যুদ্ধে শহিদ হন।
পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পতনের পরে ১৭৬৫ সালে এ-অঞ্চল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯৩ সাল থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালুর পর এই অঞ্চলসহ বৃহত্তর ঢাকা, বাকেরগঞ্জ এলাকা কিছু অংশ ঢাকা-জালালপুর নামে নতুন জেলাভুক্ত হয়। ১৮০৭ সালে ঢাকা-জালালপুরের জেলা সদর ফরিদপুরে স্থানান্তরিত হয়। ১৮১৫ সালে ফরিদপুর জেলা একজন সহকারী কালেক্টরের অধীনে পূর্ণাঙ্গ জেলারূপে আত্মপ্রকাশ করে। শরীয়তপুর অঞ্চল বিক্রমপুর থেকে ১৮৬৯ সালে বাকেরগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৭৩ সালে এটি ফরিদপুর জেলাভুক্ত মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্গত হয়। ১৯১০ থেকে ১৯৩৫ সালের দিকে এ-অঞ্চলের বহু বিপ্লবী ভারতের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। শান্তি সেন, সন্তোষ ব্যানার্জী, লোনসিং গ্রামে জন্মগ্রহণকারী বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস এদের অন্যতম। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীনতাযুদ্ধে এই অঞ্চলের মানুষ ব্যাপক অবদান রাখে। বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে শরীয়তপুরবাসীর ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। প্রশাসনিক সুবিধার্থে মাদারীপুরের পূর্বাঞ্চল নিয়ে একটি পৃথক মহকুমা গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯১২ সাল থেকে। কিন্তু সেই উদ্যোগ এক পর্যায়ে এসে থেমে যায়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে জেলাটি ফরিদপুরের মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৭৬ সালে মাদারীপুরের পূর্বাঞ্চল নিয়ে একটি নতুন মহকুমা গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তউল্লাহর নামানুসারে ‘শরীয়তপুর’ নামে নতুন একটি মহকুমা গঠিত হয়। নবগঠিত মহকুমার অন্তর্ভুক্ত হয় পালং, জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ, গোসাইরহাট ও ডামুড্যা থানা। সদর দফতর স্থাপিত হয় পালং সদরে। আর মাদারীপুর সদর, রাজৈর, কালকিনি ও শিবচর থানা থেকে যায় মাদারীপুর মহকুমায়। প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের ফলে দেশের সকল মহকুমা জেলায় উন্নীত হলে ১৯৮৩ সালের ৭ মার্চ শরীয়তপুর জেলা গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। জেলা হিসেবে শরীয়তপুরে অগ্রযাত্রা শুরু হয় ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ। শরীয়তপুর নামে কোনো স্থান না থাকলেও প্রথমে মহকুমা ও পরে জেলার মর্যাদা লাভ করে শরীয়তপুর। শরীয়তপুর জেলা ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত। শরীয়তপুর জেলা সদর পালং নদীর তীরে অবস্থিত।
শরীয়তপুর জেলার আয়তন ১৩৬৩ বর্গকিলোমিটার। এর ভৌগোলিক অবস্থান হলো উত্তর অক্ষাংশ ২৩.০১ ০ থেকে ২৩.২৭ ০ এবং পূর্ব দ্রাঘিমাংশ ৩০.১৩ ০ থেকে ৯০.৩৬ ০। এর উত্তরে পদ্মা নদী ও মুন্সীগঞ্জ জেলা, পূর্বে মেঘনা নদী ও চাঁদপুর জেলা, পশ্চিমে মাদারীপুর জেলা ও দক্ষিণে বরিশাল জেলা। এ-জেলার উল্লেখযোগ্য নদীর মধ্যে রয়েছে পদ্মা, মেঘনা, কীর্তিনাশা, দামুদিয়া, আড়িয়াল খাঁ, পালং, নয়াভাঙ্গানী, মরাগঙ্গা, ফাইসাতলার দোন, কালিগঙ্গা, লেদাম প্রভৃতি।
হাজী শরীয়তউল্লাহ ধর্মীয় সংস্কারক, নীলকর ও সামন্তবাদ বিরোধী নেতা এবং ভারতবর্ষে সংগঠিত ফরায়েজি আন্দোলনের মুখপাত্র। তিনি শুধু ধর্মীয় সংস্কারক ছিলেন না, বরং কৃষক, তাঁতি এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ থেকে মুক্ত করার জন্য সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন মুসলমানদের মাঝে দিনে দিনে যে ধর্মীয় কুসংস্কার প্রবেশ করেছে তা উচ্ছেদ করে তাদের ইসলামের মূল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। অনেকের মতে, তিনি ওয়াহাবি আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ইসলামের প্রধান করণীয় কাজকে বলে ‘ফরজ’। এই চিন্তা থেকেই তাঁর সংস্কার আন্দোলনের নাম হয় ‘ফরায়েজি আন্দোলন’।
শরীয়তউল্লাহর জন্ম তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ফরিদপুর জেলার চর শামাইল গ্রামের এক দরিদ্র তালুকদার পরিবারে। ছেলেবেলায় তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। তাঁর গুরু মওলানা বাশারত আলীর সাথে ১৭৯৯ সালে মক্কায় হজের উদ্দেশ্যে গমন করেন। ১৮১৮ সালে সেখান থেকে দেশে ফিরে আসেন। তিনি আরবি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন।
বাংলার মুসলমানদের মাঝে বেশ কিছু সংখ্যক ছিল ধর্মান্তরিত। তাই মুসলমান হওয়ার পরে স্বাভাবিকভাবে তাদের মধ্যে পূর্বধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব থেকে যায়। এগুলো প্রকট হয়ে দেখা দেয় বাংলায় ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে। মক্কায় তিনি ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ এবং সৈয়দ আহমদ বেরলভীর চিন্তাধারা দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। মক্কায় থাকাকালীন তিনি সংকল্পবদ্ধ হন যে, দেশে ফিরে তিনি সমাজসংস্কারে মনোযোগী হবেন। তাই তিনি মক্কা থেকে দেশে ফিরে সমাজসংস্কারে মনোনিবেশ করেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে এ অঞ্চলে তাঁর নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তা ফরায়েজি আন্দোলন নামে পরিচিত। তিনি দুই রকম পাপ থেকে মুসলমানদের বিরত থাকার কথা বলেন। প্রথমত ‘শিরক’ আর দ্বিতীয়টি হলো ‘বেদাত’। এই লক্ষ্যে তিনি মুসলমানদের দুই দফা নির্দেশনা দেন।
১) আত্মবিশ্বাস জাগ্রতকরণ: এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করা। কারণ সে সময়ের মুসলমান সমাজ পীর পূজা, কবর পূজা, মনসা পূজা, শীতলা পূজা ইত্যাদি নানা ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল। তিনি মুসলমানদের জীবনব্যবস্থা থেকে ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কারগুলো দূর করে কুরআন ও সুন্নাহ মতে জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করা এবং ইসলামের ‘ফরজ’ কাজগুলো অবশ্যম্ভাবী পালন করার উদাত্ত আহ্বান জানান। আর এই ‘ফরজ’ কথাটি থেকেই ফরায়েজি শব্দটি এসেছে।
২) মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিস্তার ও অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনার প্রয়োজনীয়তা শরীয়তউল্লাহই প্রথম রাজনৈতিক দূরবীক্ষণ দ্বারা অনুভব করেছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান ছাড়া ভারতবর্ষের জনগণের মুক্তি অসম্ভব। আর এজন্য তিনি দরিদ্র কৃষক, তাঁতিসহ শোষিত শ্রেণিকে—মহাজন, জমিদার, নীলকর, বণিকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান এবং আরবের ওয়াহাবি আন্দোলনের আদলে ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন। নীলকর ও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতেন। তাঁর প্রবর্তিত ধর্মমত ছিল আধুনিক ও মানবতাবাদী। তৎকালীন সমাজের উৎপীড়নমূলক নিয়ম রদ করে ভণ্ড মোল্লা মৌলবীদের হাত থেকে তাঁর শিষ্যদের রক্ষা করেন। একারণে রক্ষণশীল ধনী মুসলমানগণেরা তাঁকে ঢাকা থেকে বিতাড়িত করে। ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার অসংখ্য কৃষক তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। তার ছেলে দুদু মিয়াও একজন ঐতিহাসিক যোদ্ধা ও ফরায়েজি আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনি নীলকরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ব্রিটিশদের তাড়াতে ভূমিকা রেখেছিলেন। হাজী শরীয়তউল্লাহর আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেননি। বরং তিনি চেয়েছিলেন ধর্মীয় জীবনে পরিশুদ্ধির মাধ্যমে মুসলমানরা যেন নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারে।
হাজী শরীয়তউল্লাহর ১৮৪০ সালে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বর্তমানে মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃতদেহ জন্মস্থান চর শামাইলে সমাহিত করা হয়। আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙ্গনের ফলে হাজী শরীয়তউল্লাহর কবর নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তবে বাহদুরপুর মাদ্রাসা- মসজিদ প্রাঙ্গনে পারিবারিক কবরস্থানে পুত্র দুদু মিয়াসহ অন্যান্যদের কবর রয়েছে।
শরীয়তউল্লাহর নামানুসারে বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া তাঁর নামে মাদারিপুরের শিবচরে আড়িয়াল খাঁ নদের উপরে নির্মিত সেতুটির নামকরণ করা হয়েছে হাজী শরীয়তউল্লাহ সেতু। ১০ মার্চ ১৯৯৩ সালে তাঁর নামে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ডাকটিকিট বের করে। তাঁর জীবনী অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১। বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: শরীয়তপুর, বাংলা একাডেমি, ২০১৩।
২। বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার ফরিদপুর (নুরুল ইসলাম খান সম্পাদিক), সংস্থাপন বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ঢাকা, ১৯৭৭।
৩। আনন্দনাথ রায়, ফরিদপুরের ইতিহাস, তপন বাগচী সম্পা., বইপত্র প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৮।
4| Uddin, Sufia M. Constructing Bangladesh: Religion, Ethnicity, and Language in an Islamic Nation, University of North Carolina Press, 2006.
5| Haji Shariatullah, Muslim Ummah of North America। Muslim Ummah of North America, 20015.
৬। হাজী শরীয়তউল্লাহ, বাংলাপিডিয়া, bn.banglapedia.org
৮। আবদুর রব শিকদার, শরীয়তপুর অতীত ও বর্তমান, প্রকাশক নীলা শিকদার, ঢাকা, ২০০৭।
৯। সংসদ বাংলা চরিতাভিধান, কলকাতা সাহিত্য সংসদ।
লেখক : শিক্ষক (৩৫ তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা)- ইতিহাস বিভাগ।