‘১১১১’ নিছক কোনো সংখ্যা নয় : : খান নজরুল ইসলাম

‘১১১১’ নিছক কোনো সংখ্যা নয়

খান নজরুল ইসলাম











বিভিন্ন জেলা থেকে পরাজয়ের সংবাদে পাকিস্তানি সেনাদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। দিশেহারা হয়ে বিভিন্ন স্থানে আত্মসমর্পণ শুরু হয়ে গেছে। ডিসেম্বর নয় তারিখ পাকিস্তানি সিনিয়র সৈনিকদের গোপন বৈঠক। আলবদর, আল-শামস ও রাজাকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় নেতারা গা-ঢাকা দিচ্ছে। এদিকে ভারতের চতুর্মুখী আক্রমণ ও গেরিলা বাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাদের নাজেহাল অবস্থা। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে খুব শীঘ্রই দেশ ছাড়তে হবে! বহিঃবিশ্বের চাপ এবং নিশ্চিত পরাজয়ের পূর্বাভাস মাথায় নিয়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো মারাত্মক রিস্ক। পাকিস্তানি সাধারণ সৈনিকরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে যুদ্ধ ছেড়ে বেরাকে অবস্থান নিচ্ছে। গভীর উৎকন্ঠায় গভীররাত পর্যন্ত রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলে। এরই মধ্যে পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে নির্দেশ আসে যদি যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত মনে করো তবে বাংলাদেশ যাতে পরিপূর্ণ সফল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হয় এমন একটা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হবে। বাংলাদেশ সৃষ্টির আকাঙ্খা বাঙালিদের ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো তা বিশ্বকে বোঝাতে হবে। বাংলাদেশ যেন সফল রাষ্ট্র পরিচালনায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয় এমন ছক তৈরি আগেই করা ছিলো। শিক্ষা, চিকিৎসা, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের ব্যর্থ করে দিতে হবে। বাংলাদেশের মেধাবী পেশাজীবী এবং বুদ্ধিজীবীদের তালিকা যা আগেই প্রস্তুত করা ছিলোতাঁদের হত্যা করতে পারলেই বাংলাদেশ ব্যর্থ হবে।

আলবদর, আল-শামস, রাজাকারের সহযোগিতা নিয়ে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো করে হত্যা করতে হবে। কিছু বুদ্ধিজীবীদের আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের ধরার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, কূটনীতিক, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রায় ১৬শত নামের তালিকা উপস্থাপন হলো। এদের মধ্যে প্রায় দুই শতাধিক আগেরই বন্দী। বাকীদের দ্রুত ধরে এনে হত্যা নিশ্চিত করার নির্দেশনা এলো। জাতিকে মেধাশূণ্য করে দেওয়ার এই নিপুণ কৌশল যতো দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যেহেতু পরাজিত হইনি সুতরাং আত্মসমর্পণ তাদের কাছে করবো না। তারা মুসলিম আমাদের ভাই তাদের যুদ্ধে জড়ানো হয়েছে। ভারতের প্ররোচনায় শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে এই যুদ্ধ। আমাদের রেখে যাওয়া সহযোগী মিত্র এবং পাকিস্তানি ধর্মীয় মূল্যবোধ অনুসরণকারী বাঙালি সহযোদ্ধারা একদিন এই বাংলাদেশ ভেঙ্গে দিয়ে আবার পূর্ব-পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করবেই সুতরাং আমাদের আত্মসমর্পণ করলে ভারতের যৌথবাহিনীর কাছেই করতে হবে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর কাছে নয়। পশ্চিম-পাকিস্তানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা পেয়েই সৈনিকরা নেমে পড়ল বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিধনে। আলবদর ও অন্যান্য বাহিনীর সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসনে এবং সম্ভব্য স্থানে অভিযান চালিয়ে দেশের বুদ্ধিজীবীদের ধরতে শুরু করলেন। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকে ১৪ তারিখের মধ্যে তারা ১১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে ধরতে এবং শহিদ করতে সক্ষম হন। এদের মধ্যে ছিলেন:

৯৯১ জন শিক্ষক

১৩ জন সাংবাদিক

৪৯ জন চিকিৎসক

৪২ জন আইনজীবী

১৬ জন অন্যান্য পেশাদার

মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, রায়ের বাজার এবং মিরপুরে তাদের হত্যা করা হয়।

উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন

০১/ অধ্যাপক মুনির চৌধুরী

০২/ ডাক্তার আলীম চৌধুরী

০৩/ ডাক্তার ফজলে রাব্বি

০৪/ ডাক্তার মুহাম্মদ মুর্তজা

০৫/ অধ্যাপক মনিরুজ্জামান

০৬/ অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র( জি সি)দেব

০৭/ অধ্যাপক জ্যাতির্ময় গুহ ঠাকুরতা

০৮/ অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য

০৯/ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ

১০/ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী

১১/ আনোয়ার পাশা

১২/ সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেন

১৩/ শহিদুল্লাহ কায়সার

১৪/ খন্দকার আবু তালেব

১৫/ নিজামুদ্দিন আহমেদ

১৬/ এস এ মান্নান (লাডু ভাই)

১৭/ আ ন ম গোলাম মোস্তফা

১৮/ সৈয়দ নাজমুল হক

১৯/ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন

২০/ মোহাম্মদ আখতার

২১/ শহীদ সাবের

২২/ আলতাফ মাহমুদ

২৩/ রাশীদুল হাসান

২৪/ মোহাম্মদ আবুল খায়ের

জাতিকে মেধাশূন্য করার নিপুণ কৌশলে তারা জয়ী হলেও যুদ্ধে জয়ী হতে পারেননি। বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ সহবস্থান, দৃঢ়তা ও সাহসিকতার নিকট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজয় হতে হয়েছিল। নির্যাতন নিপিড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনগণ জেগে উঠলে যে কোনো বৃহত্তম শক্তিকে পরাজয় করা কতোটা সহজ তা বাংলার দামাল ছেলেরা সেদিন বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মদান বাঙালি জাতি চিরদিন স্মরণ করবে।

4 تعليقات

  1. লেখাটি তথ্য নির্ভর যা প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানার জন্য সহায়ক। পত্রিকার সম্পাদক সহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা সীমাহীন।

    ردحذف
  2. চমৎকার তথ্যবহুল লেখা ।এমন তথ্যবহুল লেখা আমাদের সবাইকে পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য কবি খান নজরুল ইসলামকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
    আশা করি ভবিষ্যতেওএমন আরো লেখা পাবো তার কাছ থেকে।

    ردحذف
إرسال تعليق
أحدث أقدم