কবি গোলাম রসুলের কবিতায় বৈশ্বিক পীড়ন, আত্ম-দ্বন্দ্ব ও ঈশ্বর ভাবনা :: কৃষক মাহমুদ

কবি গোলাম রসুলের কবিতায় বৈশ্বিক পীড়ন, আত্ম-দ্বন্দ্ব ও ঈশ্বর ভাবনা

কৃষক মাহমুদ

কবি এক ধ্যানী ব্রহ্মা। ফুলের বাদশা। সুতীব্র নায়ক। যিনি জাগতিক স্বাদে সন্ধান করেন অলৌকিক ঈশ্বরপোনা অথবা লৌকিকতার মধ্য জানালায় এক প্রজাপতি শুদ্ধতার। সন্ধান করেন কোনো এক আকাশমণি তরুলতা। ছিপ ফেলা জানালায় প্রিয়ার আসমুদ্রিক তৃষ্ণাকাতর ঠোঁট। ভেতরে ভেতরে যিনি ব্রহ্মাণ্ড দ্রষ্টা। এই দৃশ্য আহারান্তে যিনি হয়ে ওঠেন ভাববাদী স্রষ্টা বা স্ব-ভাষার ভাব বৈজ্ঞানিক। বিজ্ঞান ও কবির দৃষ্টি ও সৃষ্টি প্রক্রিয়া আলাদা দৃশ্যান্তে আলাদা হলেও, ভাবান্তে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কবির থাকে সচিত্র শব্দ দৃশ্য, অক্ষর ঔষধি এবং বিজ্ঞানের থাকে বস্তু দৃশ্য, পদার্থ দৃশ্য বায়বীয় এবং জলীয় দৃশ্যের প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্য ইত্যাদি। তবে সব তরিকায় পরিবর্তনশীলকবি থেকে কবির, ভাষা থেকে ভাষার, বিজ্ঞান থেকে বিজ্ঞানের।

 

কবি ঘরের কোণে বসে বৈশ্বিক পীড়ন দেখেন। তাঁর আছে পরিস্কার আত্মার দূরবীন। কবি ঘাসের পরানে পরিয়ে দিতে জানেন তারার অলঙ্কার। বাতাসকে দাঁড় করিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। রোদের সাক্ষাৎকার নিতে পারেন ঠিক এভাবে, ‘ইদানিং তোমার শরীর খারাপ যাচ্ছে কেন?’ বিজ্ঞান একটা বিষয় বিশ্লেষণ করে, গবেষণা করে, একটা সত্যের ঘরে আলো জ্বালাতে চায়, কবি ঠিক সেরকম কিছুই করেন। বিজ্ঞানী দেশ, জাতি, সভ্যতার জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে আর কবি একটি ভাষার ভবিষ্যৎ পথ প্রশস্ত করতে করতে চলে জান। এটা যেন একই মুদ্রার এপিট ওপিট।

 

সর্বশেষ কবির সব সন্ধান, অনুসন্ধান, দৃশ্যপুরাণ, অদৃশ্য আহার, বৈশ্বিক আত্মার হত্যার মধু সংগ্রহ, যা কিছু তাঁর সব কিছুতেই কবিতার সন্ধান মাত্র। আকাশের ঘরে, পাতালের জলে, গ্রহ নক্ষত্রের কোলবালিশে, রান্নাঘরে, রমণীর সাজঘরে কিংবা নগ্ন নৃত্যরত সঙ্গমশাসিত আনন্দ দেহের বাতাসেও কবির কবিতার খোঁজা। কখনো কখনো কবি তার অন্তর জগতে যুদ্ধ বা সংঘাত ঘটিয়েও কবিতার নন্দন আগমন কামনা করে থাকেন। ঈশ্বরের সাথে কথা বলতে কবি প্রথমত নিজেকেই খুঁজে নেন, তার পরে নিজেকে ইচ্ছার তরবারে কুচি কুচি করে কেটেও কবিতার সন্ধান করেন। সন্ধান করতে বাদ রাখেন না সে অন্য কোথাও, যেটা তাঁর সাধ্যের মধ্যে। কবি রূপের এক প্রজাপতি। বলছি কবি গোলাম রসুলকে নিয়ে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৯ সালে। গ্রাম- ভাড়ড়, ২৪ পরগনা (দক্ষিণ), পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। কবি গোলাম রসুল-এর প্রকাশিত গ্রন্থ : কষ্ট (২০০৯), যশোর রোড (২০০৯), টিনের বাড়ি (২০০৯), বৃষ্টির একপাশে উড়ছে পাখিরা (২০১০), আমি এক অচেনা মানুষ (২০১১), আমরা একসঙ্গে কেঁদে ফেললাম (২০১১), বেলা দ্বিপ্রহরে (২০১২), বিন্দুতে বিন্দুতে কথা হয় (২০১৩), দুই মাস্তুলের আকাশ (২০১৪), পূর্বাহ্ণে ঢেঁকিছাটা ধূসর (২০১৫), মেঘ এখানে এসে অন্যমনস্ক হয়ে যান (২০১৫), লাল হয়ে আছে রাগি আকাশ (২০১৬), মরুভূমি চিহ্ন (২০১৬), নিদারুণ ছায়া (২০১৯), বিস্ময়ের গলিতে চাঁদ (২০১৯), পৃথিবীর মেঘ আমরা পেরিয়ে এসেছি (২০১৯), শূন্য যেখানে শূন্য নয় (২০২১) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

আমি কখনো ভারত যাইনি। না এই কবির কোনো বই পড়েছি। কোনো কবিকে পাঠ নিতে হলে তাঁর দেশে যেতে হবে বা টেক্সটবই পড়তে হবে এমন তো নয়। বর্তমানে অনলাইনই হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো পাঠশালা। আমি তাঁর ফেসবুক আইডি থেকে প্রচুর কবিতা পড়েছি। তিনি তাঁর সব কবিতাই ফেসবুকে পোস্ট করে থাকেন। আমি কবিতার তৃষ্ণায় থাকি। ভালো কবিতা খোঁজার এক রোগ আছে আমার। আর সেই থেকেই নানা ভাবে ভালো লেখক বা লেখা খুঁজে ফিরি। সেটা আমার দেশের হোক, বিদেশের হোক, বাংলা ভাষার হোক বা অন্য ভাষার হোকসেটা আমার দেখার বিষয় নয়। প্রয়োজন ভালো লেখা। আমার প্রোফাইলে প্রায় পোস্ট করতাম। বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে সেখানকার কবি সাহিত্যিকেরা কেমন লিখছেন, আমরা কেমন লিখছি। এ এক রকম ক্ষুধা আর কী। আমার ফেসবুক বন্ধু হাফিজুর রহমান, তিনিও ভারতের। তিনি একদিন এই মহাজাগতিক কবির ফেসবুক প্রোফাইলের লিঙ্ক দেন। সেদিন থেকেই কবি গোলাম রসুলের সাথে আমার ভাব গড়াতে থাকে। আর কবিতা যত পড়তে থাকি ততই যেন অবাক হতে থাকি, ভাবি এমন লেখককেই বা এমন লেখাকেই তো খোঁজ করছিলাম এতদিন। তাঁর কবিতা পড়ে মনে হলো জীবনানন্দের পরে যদি কোনো কবি থাকে তো তিনিই আছেন। দুই বাংলার শ্রেষ্ট কবি বর্তমান তিনিই। দুই বাংলার কবিদের মধ্যে বর্তমান কবি গোলাম রসুলই শ্রেষ্ট এবং ইউনিক ধাচের কবিতা লেখেন। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। তাঁর কবিতার দৃষ্টি ও শক্তি এক ও অনন্য অসাধারণ। কবিতার ভাব, ভাষা, নির্মাণশৈলী, ছন্দ,  উপমা, উপমেয়, চিত্রের চিত্রায়ণ কিছু কিছু কবিতায় যেন উপমার হাট বসে যায়। অভিভূত হয়। বসে বসে শুধু ভাবি কিভাবে সম্ভব। এভাবেও কি ভাবা সম্ভব? আসুন কবির কিছু কবিতাংশ পড়ে স্বাদ নিয়ে দেখি

‘‘কাঠের বাক্সের ভেতর অরণ্যের আন্দোলনের মাথার খুলি পাওয়া যায়’’

 

একই কবিতায়

 

‘নক্ষত্রের আগুনের কেঁচো

চাঁদের বৃশ্চিক

মুঠো মুঠো সোনার পিঁপড়ে

কেউ আমাকে টলাতে পারবে না যখন আমি পান করব ইথার

 

নরকের আগুন

আমি তোমার মধ্যে বন্দি করব পৃথিবীর জল’

 

জীবনানন্দ যেভাবে চাঁদ, নক্ষত্র, অরণ্য, প্রকৃতি, পৃথিবী দেখেছেন, ভেবেছেন, এই কবি সেভাবে না দেখে সেই একই জিনিস অন্য ভাবে অন্য উপমায় দাঁড় করাতে ব্যস্ত। কিন্তু আমি এই কবির ফসল, মাঠ, ধান, শুয়োপোকা, করমচা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতে দেখি না বা এমন আবহ সৃষ্টি করছেন না। তিনি ব্যস্ত আছেন চাঁদ, সূর্য, এক কথায় মহাজাগতিক বিষয় ভাবনা নিয়ে। আমাদের বাংলাদেশে কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দের পরে এই কবির কবিতা পড়ে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার নিকট কবি গোলাম রসুলকে উত্তর আধুনিক বা পোস্ট মর্ডানিজমের কবি মনে হয়। তিনার সব কবিতায় উত্তর আধুনিক বা পোস্ট মর্ডানিজমের কবিতা। তবে পোস্ট মর্ডানিজমের কবিতা আরো একধাপ চূড়ান্ত পর্যায় যাবে। তবুও তিনি পোস্ট মর্ডানিজমের কবি বলেই আমি ধরতে চাচ্ছি। আসুন এই কবির আরো কিছু কবিতা পড়ে দেখি। সাম্প্রতিক একটা কবিতায় তিন ধরনের বোধ বা বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে। সেখানে বিদ্বেষ ও বংশ পরম্পরার গ্লানি থেকে এক রকম শ্লাঘা পাত লক্ষ্য করতে পারি আমরা। ‘জলের যাযাবর জাতি’ কবিতার দেখি

‘শুকনো কাঠের শোকাতুর শব্দ আসছে

যেখানে সূর্য এক দিন চারা গাছ লাগিয়ে ছিল’

 

পাঠক হিসাবে বলতে পারি, কবি এখানে আত্মার ক্লেদ প্রকাশ করেছেন। মানে মানুষ মানুষকে এভাবে হত্যা করছে যে কাঠের শোকাতুর শব্দ শোনা যাচ্ছে। সূর্য হতে পার ঈশ্বরের প্রতীকী কিছু। আমি এই কবির অনেক কবিতা পড়েছি। তিনি সব খানেই কেমন আত্মদ্বন্দ্বে ভোগেন। বিশ্বায়নের পীড় তাঁর তীক্ষ্ণ বোধকে তাড়া করে। কবির কবিতা ভাবনা ও কবিতার বিষয়বস্তু হলো বিশ্বায়ন। বিশ্বের সকল অনিয়ম, হত্যা, যুদ্ধ, ধর্মের বিভেদ, জাতি বর্ণের বিভেদ ও হানাহানির ক্লান্তি সব কিছু একীভূত হয়ে ধরা দেয় তাঁর কবিতায়। অন্যান্য বিষয়ের মতো সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ধর্ম, জাতি, বর্ণ ও লিঙ্গ বিভেদ প্রতিয়মান। এসব বিভেদের ছুতোয় সমৃদ্ধ কবি লেখকদের অনেকেই প্রোমট করে না, সম্মান দেখায় না। শুধু তাই নয় তাঁরা মাঝে মাঝে উগ্র আগ্রাসনেরও স্বীকার হন। এটা অনেকটা রাজনীতির খেল। যাই হোক কবি এসবে ক্লান্তকবি আশ্রয় নেন তাঁর একান্ত কবিতায়। কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় কবিতা হলো কবির আশ্রয়।

 

জীবনানন্দ দাশের ভাবনা আর কবি গোলাম রসুলের ভাবনা, বোধের তাড়না, দর্শনের জায়গা কতোটা আলাদা, সেটা এই কবির কবিতা পাঠ নিলেই অনুমান করা যায়।

2 تعليقات

إرسال تعليق
أحدث أقدم