কবি ইব্রাহিম খলিলের একগুচ্ছ ছড়া-কবিতা

কবি ইব্রাহিম খলিলের একগুচ্ছ ছড়া-কবিতা 

ভিন্নতা

চেনাজানা মানুষগুলোর

ভিন্ন রকম ধরন

ভিন্ন ভিন্ন গায়ের রংটা

ভিন্ন তাদের গড়ন।

 

রীতিনীতি হাঁটাচলা

ভিন্ন রকম সব

ভিন্ন রকম খাদ্যনীতি

ভিন্ন রকম জব।

 

কথা বলার ধরনটাও

একই রকম নয়

হাঁটাচলা চোখের চাওয়া

ভিন্ন রকম হয়।

 

মনটা কারো উদার বেশি 

কারো ভেতর খাদ

একই ঘরে বাস করেও 

ভিন্ন মতবাদ।

 

সব কিছুতেই ভিন্নতা রয়

এক জায়গাতেই মিল

সবার ভেতর রক্তটা লাল

নয়তো কারো নীল।

 

শকুন

বোধের দ্বারে পেরেক ঠুকে

রুদ্ধ বিবেক বোধ

হিংস্র থাবায় জীবন কেড়ে

এ কোন প্রতিশোধ?

 

জীবনটা কী তুচ্ছ এতই

পুতুল নাচের খেল

দেশটা যেন সবার কাছেই

আয়না ঘরের জেল।

 

সেই পুরানো চেনা শকুন

রক্তে ভেজা ঠোঁট

মা মাটিকে ঠোকর দিতে

হয়েছে একজোট।

 

থাকতে সময় রুদ্ধ করো

শিকল পরাও পায়

যায় না বলা আবার শকুন

কাকে গিলে খায়।

 

চতুর নেতা

নাইবা থাকুক পদ পদবী

নাইবা খ্যাতি যশ

তার পরেও বলেন কথা

মুখটা ভরা রস।

 

শোনে বেশি অল্প বলেন

লিখেন আরো ঢের

নালা পুকুর দেন বানিয়ে

চিংড়ি চাষের ঘের।

 

সব কিছুতেই নাকটা গলান

দেন ঢুকিয়ে হাত

চোখের সামনে শুকনো মুড়ি

দেন বানিয়ে ভাত।

 

মুখের কথায় যাদু আছে

শ্রোতার অভাব নাই

মুঠোয় রাখা স্বপ্ন গুড়া

দেন বানিয়ে ছাই।

 

বায়বীয় ম্যাজিক নেতা

সবখানে তার রাজ

মিছিল মিটিং না করেও

করেন দলের কাজ।

 

উপদেশ

তিলকে তুমি তাল ভেবো না

তালকে আবার তিল

ছাগল দেখে খোঁজ করো না

হরিণ ছানার মিল।

 

কালো তুমি কালোই ভাবো

সাদাগুলো সাদা

ভুল করেও কাঁচা হলুদ

ভেবো না-তো আদা।

 

কোকিলটাকে কোকিল ভাবো

কাককে ভাবো কাক

কাককে কোকিল ভাবলে পরে

খুঁজবে ক্ষতির ফাঁক।

 

ভীতুদেরকে ভীতুই ভাবো

বীর ভেবো না ভুলে

সব ভীরাই কারণ থাকে

সর্বনাশের মূলে।

 

কবিতার বুনন

কবিতার গায়ে আঁচড় কেটে কেটে

রক্তাক্ত করেছো দেহ,

ঠিক যেনো কোনো ধর্ষিতা নারী

আশ্রয় খোঁজে সুশীলের কাছে।

পঁচন ধরেছে কলমের আগায়,

তাইতো আর আগের মতো

হৃষ্টপুষ্ট হয়ে জন্মে না কবিতা।

লাশ কাটা ঘরের মতোই

তোমার মনের ভেতরটায়,

আজকাল বাস করে ভৌতিক সত্তা।

সবুজ করেছে পর

আর, নীল ও ছেড়েছে মনের সিমানা।

ধূসর বাদামি শকুন ভর করে আছে মনের জমিনে,

শকুনেরা বোঝেনা কবিতার বুনন।

 

সত্বা

তোমার ভেতর অন্য তুমি

বাস করে যাও রোজ

খোলসটাকে বাইরে রাখো

ভেতর করো খোঁজ।

 

বাইরে তুমি হিংস্র হলে 

ভেতরটাতে শান্ত

উপরটাতে মন্দ হলে

ভালো ভেতর প্রান্ত।

 

একই মানুষ হলেও তুমি

সত্তা তোমার দুই

এসো তবে ভালোবেসে

ভেতরটাতেই ছুঁই।

 

মানুষ

হাসতে কি পারো না

অন্যের সুখে

হিংসাটা ভুলে গিয়ে

টেনে নিতে বুকে।

 

কী এমন ক্ষতি হয়

কাঁধে দিলে হাত

কালা ধলা তাতে কী

মানুষেরই জাত।

 

মানুষ মানুষে করে

বিভেদের জাল

দুর্বল মার খায়

দেখি চিরকাল।

 

নিজেকে মানুষ বলো

ছি ছি ছি

মন পোড়া তুষ আগুনে

তুমি ঢালো ঘি।

 

মানুষ কি তারে কয়

পশু হয় সে

জেনেশুনে অন্যের

ক্ষতি করে যে।

 

প্রতি উত্তর -২

যে আমাকে খোঁচা মারে

ক্ষতি বরং তার

এক খোঁচাতে দশটা ছড়া

দেবো উপহার।

 

বুঝতে যদি তোমার খোঁচায়

আমার উপকার

তবে কি আর আমায় খোঁচা

মারতে বারে বার?

 

আমার ক্ষতি করতে গিয়ে

করছো উপকার

ঝিমিয়ে পড়া আমার মেধায়

দিচ্ছো তুমি ধার।

 

নিন্দা করো আরো বেশি

ধরতে পারো ভাব

তোমার করা হিংসা থেকেই

আমি নেবো লাভ।

 

তুমিই আমার সবচে আপন

সবচে কাছের লোক

তোমার দেয়া ব্যথায় আমার

একটুও নেই শোক।

 

বৈপরীত্য 

আমার যতো শত্রু আছে তোমার তারা

বন্ধু হোক

আমার দেখা ইতরগুলো তোমার চোখে

ভদ্র হোক।

 

আমার দেখা ডোবা পুকুর তোমার চোখে

সাগর হোক

আমার দেখা ডিঙি নাও-টা তোমার কাছে

জাহাজ হোক।

 

আমার দেখা কঠিন পাথর তোমার কাছে

হাল্কা হোক

আমার পাওয়া দু:খগুলো তোমার কাছে

সুখের হোক।

 

আমার দেখা সর্পরাজা তোমার কাছে

ওঝা হোক

আমার দেখা বাঁকা পথটা তোমার কাছে

সোজা হোক।

 

বলছে সবাই ছি

নিজের লাভের হিসেব বোঝ হিসেবে বেশ পাকা

দুস্থজনে দিতে গেলে পকেট তোমার ফাঁকা।

 

নিতে গেলে দু’হাত পাতো পারলে পাতো ঝুড়িটা

তোমার কাছে চাইলে পরে ঝাড়ি মারো কুড়িটা।

 

পেটটা তোমার আলুর গুদাম যাচ্ছো তবু খেয়ে

প্রতিবেশী থকছে ভুখা দেখছো নাতো চেয়ে।

 

খেতে খেতে সব খেয়েছো করছো খেয়ে শেষ

ঝোলার পেটে ঢুকে যাবে আস্ত পুরো দেশ।

 

তোমায় তুমি মানুষ ভাবো অন্যে ভাবে কি?

দানব তোমার মুখটা দেখে বলছে সবাই ছি।

 

এই যে কবি

এই যে কবি লিখেন ছড়া বেশ

   ছড়ায় থাকে মা মাটি আর দেশ।

           আমার দিকে একটু নজর দিন

               আমার কাছে দেশের অনেক ঋণ।

 

দু’চার কথা আমায় নিয়ে হোক

   আমার কথা জানুক দেশের লোক।

             মঞ্চে উঠে রোজ দিয়ে যাই ভাষণ

                সবখানে দেয় সভাপতির আসন।

 

জনগণের কল্যাণে এই মাথা

         রোদ বৃষ্টি ছাড়াই ধরে ছাতা।

           হাট বাজারে যখন যেথায় যাই

                      মূল্য ছাড়াই সদাইপাতি পাই।

 

কি? আমায় নিয়ে

   লিখতে তোমার বাধা?

           কে কয় তোমায় কবি

                  আস্ত গাধার গাধা।

 

ধ্যাত্তেরী ছাই কী-সব লেখো রোজ

    তোমার ছড়া গুবরে পোকার ভোজ।

        লেখায় তোমার রাস্তা ব্রিজ খাল

            সময় করে কী-সব লেখো বা,,,,,,,ল।

 

লেখা তোমার এক্কেবারে বোগাস

   তারচে বরং আমায় করো ফোকাস।

         আমার কাছে তোমার অনেক ঋণ

                    ঘুচবে তোমার দৈন্যদশার দিন।

 

 

শিক্ষা গুরু

কৃষক ছাড়া ফসলি জমি লতায় পাতায় ঘাস

যত্ন ছাড়া ফলে না ফসল পতিত বারো মাস।

 

ঠিক তেমনি তোমার মগজে বুনিয়া জ্ঞানের বীজ

শিক্ষক সে-তো তোমাদেরকেই সন্তান ভাবে নিজ।

 

ঔরসে তার জন্মে যে শিশু ঠিক তাহারই মতো

তোমাদের মাঝে খু্ঁজিয়া পায় সে সুখ আনন্দ যতো।

 

তোমার জীবনের সফলতা সব শিক্ষকের শ্রম ঘিরে

শিক্ষকেরে তাই সম্মান করো শ্রদ্ধাবনত শিরে।

 

তাহারে তোমরা যত্ন করো সম্মান করো রোজ

তাহার ভেতরেই তোমার জীবনের ভবিষ্যতের খোঁজ।

 

তাহার হাতেই তোমার জ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক শুরু

আজীবন তাই মান্য যে-জনতিনিই শিক্ষা গুরু।

 

সাম্যবাদী ছড়া

সংখ্যা গুরু সংখ্যা লঘু, যায় কী আসে তাতে

চলতে পারি পাশাপাশি, হাত মিলিয়ে হাতে।

আজান হলে মসজিদে যাই, ইবাদতের তরে

হিন্দু যে জন সময় হলেই, যাচ্ছে পূঁজোর ঘরে। 

 

তাদের পূঁজোয় স্বাধীনভাবে, আনন্দে ঢাক বাজান

প্রাণ খুলে দেয় উলু ধ্বনি, মসজিদে হয় আজান।

এমনি করেই যুগে যুগে, থাকছি মিলেমিশে

তাদের সাথে এই আমাদের দ্বন্দ্ব হবে কিসে?

 

স্বার্থ হাসিল করার জন্য তেল মারি না কারো

হোক সে কোনো সনাতনী, মগ, মুরং আর গারো।

কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে, মিলেমিশে থাকি

সাম্যবাদের প্রয়োজনেই, সু-সম্পর্ক রাখি।

 

ধর্মীয় সব রীতিনীতির, তার খাবার সে খাক

ঠিক তেমনি আমারটাও, আমার কাছেই থাক।

সাম্প্রদায়িক হামলা হলে, নিন্দা জানাই তার

আইন কানুনে বিচারটা চাই, দোষটা থাকে যার।

 

তার পরেও দ্বন্দ্ব বাধে, ধর্ম জাতি নিয়ে

সহিংসতা দেয় ছড়িয়ে, দুইটা জাতি দিয়ে।

নাটের গুরু তৃতীয় কেউ, বিছায় সুতোর জাল

বন্ধু প্রতিম দুইটা জাতির, তাতেই করুণ হাল।

 

হারানো বোধ

আমি তোমাকে খুঁজি অনন্ত অসীমে

নদীরা যেখানে এক সাথে এসে গল্প করে।

ঢেউয়ের পরে ঢেউ এসে যেখানে আছড়ে পড়ে

ঝিনুকের খোলসে আটকে থাকা বালুকণা

যেভাবে মুক্তা বানায়  

নিবিড় আলিঙ্গণে চুমু খায় এক একটি শামুক

খোলস থেকে খোলসে।

বুলেট বেধা বিদীর্ণ বুকে

যেভাবে নিতে চায় শেষ নি:শ্বাস

ঠিক সেই ভাবে

আমি তোমার বুকের প্রতিটি নি:শ্বাস পড়তে পারি।

আগ্নেয়গিরির জ্বালা মুখ দিয়ে

যেভাবে লাভা নির্গত হয়

ঠিক সেই ভাবে,

আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটে তোমার সামনে দিয়েই

তুমি অবহেলার চোখ দিয়ে একবার তাকিয়ে যাও

অনেকটা দয়া করেই।

তাতেই আমি ঠান্ডা হয়ে যাই হিমালয়ের মতোই।

তোমার মিথ্যে স্বান্তনাকে আমি ভেবে নিই

এক একটি নীলকণ্ঠ ফুলের পাপড়ি।

অনেকটা পথ হাঁটতে হাঁটতে আমি আজ ক্লান্ত

ভীষণ শক্ত আবরণের কচ্ছপের মতোই।

আমার চোখে তুমি নীল দিগন্তের নীলাম্বরী মেঘ।

সেই মেঘে আমি ভেসে ভেসে খুঁজি

তোমার লাউডগা আঙ্গুলের ছোঁয়া।

আমি শিহরিত হই,

তোমার অপ্সরা শরীরের মুদিরা সুগন্ধে।

তুমি খোলসে থাকো, খোলস জড়াও গায়ে,

তাই মাঝে মাঝে হয়ে যাও অচেনা গ্রহের ধুমকেতু।

তোমার এক একটা কথার স্ফুলিঙ্গ,      

আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করে ছাড়ে।

আমি ভেঙে পড়ি না,

তোমার শুভ্র তুলো মুখ আরো একবার দেখবো বলে।

আমি তোমাকে পড়তে পারি, অতি-উচ্চ পাহাড়েও,

মেঘেরা যেখানে এসে থেমে যায় ক্লান্ত হয়ে

যখন জোনাকীরা আলো নিভিয়ে সঙ্গমে যায় ঝোঁপে।

ডানা ঝাপটানো পাখিরা যখন

আশ্রয় খোঁজে বাড়ির কার্ণিশে।

তুমি কখনো বুঝতে চাওনি বুভুক্ষু মনের আর্তনাদ।

লাল নীল বাতি তোমাকে আকৃষ্ট করেছে।

ভাঙাচোরা ল্যম্পপোষ্টকে তুমি

ভেবে নিয়েছো চকচকে রাজ প্রাসাদ।

‘জেনে রেখো’

তখনও আমি তোমার শরীর জুড়ে রক্ত কণায় স্রোত

হাতড়ে বেড়াই ঢেউয়ের তোড়ে সেই হারানো বোধ।

 

লেখক পরিচিতি :  কবি ইব্রাহিম খলিল, জন্ম- ১২ নভেম্বর, ১৯৭৬ খ্রি:। শরীয়তপুর জেলার নিভৃতপল্লি দক্ষিণ মাহমুদপুর ইউনিয়নে। তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশ পায় দৈনিক ভোরের ডাক ১৯৯৫ সালে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে লেখালেখির হাতে খড়ি। অসংখ্য যৌথ কাব্যগ্রন্থে তাঁর লেখা স্থান পেয়েছে। 

2 মন্তব্যসমূহ

  1. কীর্তিনাশা কাব্য পরিবারকে অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাগুলোকে তাদের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে জায়গা করে দেয়ার জন্য।বিশেষ করে নির্বাহী সম্পাদক ইয়াসিন আযীয ভাইয়ের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

    উত্তরমুছুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
নবীনতর পূর্বতন