কবি খান মেহেদী মিজান এর নির্বাচিত কবিতা

 কবি খান মেহেদী মিজান এর নির্বাচিত কবিতা


সবার মাঝে একলা একা

 

সবার মাঝে একলা একা, ভীষণ একা

অথচ সব সরব মানুষ যায় যে দেখা।

দৃষ্টি সীমায় যারা আছে, যতোই দেখি

ব্যবহারে কষ্ট ভারে, মনে হচ্ছে সবই মেকি।

চোখের সামনে অনেক কিছু আছে রাখা

তবু কেনো বুকের মধ্যে করে খাঁ খাঁ?

 

নাইবা পেতাম, পেয়ে হারাই; সেই হতাশা

দুঃখ দিবে কষ্ট দিবে, তাই দিলে কি ভালোবাসা?

এক জীবনে এতো কষ্ট কোথায় রাখি

ভালোবাসার গল্প সবার, পড়লে মনে ভিজে আঁখি।

 

জিজ্ঞাসিলে বন্ধুরা কেউ

সেই মানুষটি কেমন আছে?

কেমনে বলি চোরাবালির সে নেই

এখন আমার কাছে।

 

আমি এখন সময় কাটাই, একলা একা

তার মতো কেউ দেয় না দেখা, থাকতে বহু

এ সব ভেবে কষ্ট চেপে আড়ালে যাই;

বুকের মধ্যে সারাটি ক্ষণ করে হু হু।

:::::::::::::::

 

একটি চিঠির অপেক্ষায়

 

কতো দিন তোমার চিঠি আসেনা!

একটি চিঠির অপেক্ষায় বৃষ্টিহীন অনেক তপ্ত দুপুর

ভিজিয়েছি চোখের জলে

অনেক শ্রাবণ পুড়েছি আমি বুকের জমা বিরহ অনলে

তবু তোমার চিঠি এলোনা।

 

শুধু একটি চিঠির অপেক্ষায়

দাঁড়িয়ে থাকি ডাক পিয়নের পথে।

তোমার চিঠি পড়ব বলেজেগে থাকি রাত দ্বিপ্রহর

নিঝুম তল্লাটে জ্বালিয়ে মোমের শিখা,

আজও কি হয়নি তোমার একটি চিঠি লিখা?

 

এক সাগর তৃষ্ণা এ বুকে

মিটে যাবে সব পিপাসা যদি তোমার হাতের চিঠি পাই।

হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণে ব্যথার সাগর পাড় ধ্বসে পড়ে

আজও টের পাই।

 

বসে আছি আশার বসতি ঘিরে তোমার চিঠির অপেক্ষায়

করুণা করে হলেও যেনো তোমার লেখা চিঠি পাই।

:::::::::::::::

 

সুখ

 

সুখ তুমি কী? ক্যামন সুন্দর তোমার মুখ?

এই সুন্দর ধরনীর ‘পরে হাঁটলাম

কতো প্রান্তর কতো বন্ধুর পথ;

আজও তোমার দ্যাখা পাইলাম না সুখ!

তুমি কি ষোড়শীর পেন্দনের রঙিন শাড়ী?

তোমারে কি নতুন বউয়ের মতো সাইধ্যা আনতে হয় সুখ?

নাকি ছিন্নবাস নারীর মতো ফিরো দ্বারে দ্বারে?

 

সুখ তোমারে খুঁইজ্যা খুঁইজ্যা

পঁচিশটা বছর জিরাই নাই

ঘুমাই নাই দু’দণ্ড রাতের!

তবু তোমার দ্যাখা পাইলাম না সুখ

প্রিয়তমার মতো কি তোমার মুখ?

তবে তারেই সাইধ্যা আনুম ঘরে।

 

সুখ তুমি কি রাঙা ঠোঁটের হাসি

নাকি চোখে ঝরা লোনা জল?

সুখ তুই কি আন্ধার রাইতের বাতি?

নাদু’চোখে যখন কিছু দেখি না

তখন আসমান হতে বিলানো চাঁন্দের আলো।

তাহলে আর ঘরে ফিরুম না

ওই আলোরেই ভালোবাসুম

সারা জীবন ওর সাথেই করুম ঘর-সংসার।

 

যার কাছে জিগাইছি সুখের কথা

সেই শুনায় দুঃখ আর ব্যথা

ক’ সুখ তোরে খুঁজবার আর কোথায় যাই?

জীবনান্তে একবার পাইলে জিগাইমু; সুখ

কে তোরে বানাইছে কার লাগিয়া?

আমি তোরে সারা জীবন পাইলাম না মাগিয়া।

 

ক্যানো এতো দুঃখ দিলি সুখ?

একবার প্রিয়তমার মুখ হয়েদ্যাখা দে অন্তত

কথা দিলাম: ভুইল্যা যাইমুদুঃখ পাইছি যতো।

:::::::::::::

 

বিপুলা

 

বিপুলা তুমি আছো, বেশ আছো

ভালোই কাটে দিন

তোমার নদীর তীরে আমি

এক; বৃক্ষ প্রাচীন।

 

বিপুলা তুমি সরোবরে

নীল পদ্ম জলে

আমি ঝরা অনাদরী

শিউলী পদতলে।

 

বিপুলা তুমি আছো, বেশ আছো

কণ্ঠ ভরা গান

আমার হৃদয় ছেঁড়া তারে

সুরহীনা একতান।

 

বিপুলা তুমি আছো, বেশ আছো

ফাল্গুনী রঙ মেখে

বসন্ত মোর বলবে না কেউ

অনল বৃক্ষ দেখে।

 

বিপুলা তোমার চোখে নীল স্বপ্ন আঁকা

ঠোঁটের হাসি লাল

অশ্রু ফোঁটা গড়িয়ে ভিজে মোর

ভাঁজ পড়া কপোল।

 

সুখের দীঘি ঝিকিমিকি

তোমার সুখের পাল

সেথায় গড়ায় ফোঁটায় ফোঁটায়

আমার চোখের জল।

 

তোমার যেথা ফুটলো সরোজ

নীল পদ্ম জল

সেথায় আমার ফুটলো আজি

ব্যথার নীলোৎপল।

:::::::::::::::::::::

 

আবাসন দখলে কাঁদে পোঁয়াতী ফসলের ক্ষেত

 

আনমনে বসেছিলাম দ্রুতগামী বাসের জানালায়।

শাঁ-শাঁ করে অতিক্রম করছে সবুজ বৃক্ষের সারি,

মাঠ-ঘাট-প্রান্তর; মাইলকে মাইল পথ।

আর্তনাদে করুণ শব্দ ভেসে আসে বাতাসে

ধ্যান ভেঙে চোখ খুলতেই দেখি

আবক্ষ ডুবে আছে শীষ ধরা ফসল

ফসলের ক্ষেত জুড়ে সাইন বোর্ডের দাপাদাপিঃ

গ্রুপে গ্রুপে দখলের রাজত্বে নেমেছে

সাইনবোর্ড বাহিনী।

 

ভূমি হারানো কৃষকের চোখে অন্নাভাবের হতাশা!

অবাধে উজাড় হচ্ছে সবুজ অরণ্য

নাভিশ্বাস ওঠছে জনজীবনে।

চারদিকে ধেয়ে আসছে বালুর প্রপাত

আগ্রাসনে লুটিয়ে কাঁদে পোঁয়াতি ফসলের ক্ষেত।

:::::::::::::::

 

আমাদের নদীগুলো খুব দুখী

 

আমাদের নদীগুলো আজ খুব দুখী

ফারাক্কা, তিস্তা আর টিপাইমুখের

বাঁধের ফাঁদে কাঁদে ওরা

নদী শাসনে জলের গতিরোধ!

 

জল শুকিয়ে জেগে ওঠা চরগুলো

ভর করেছে নদীর বুকে। কুলকুল জল বহেনা আগের মতো।

নেই উত্তাল তরঙ্গ। শুকিয়ে যাওয়া দুধহীন স্তনের মতো

নদীগুলো আজ মরুভূমিতে...

নদীর কোল জুড়ে আজ মাছেরা করে না কিলবিল

শস্যহীন ভূমি যেন পড়ে আছে খিল।

 

তেরোশত নদী নামের জলাশয়ে যেটুকু আছে বাকি জল

প্রতিদিন তেরো লাখ লিটার কেমিকেল বর্জ্য মিশে অবিরল!

বুড়িগঙ্গা শীতলক্ষ্যা ধলেশ্বরীর জলে আজ উৎকট গন্ধ

পরিবেশ প্রকৃতি জনজীবন হারাচ্ছে টিকে থাকার ছন্দ।

 

একদিন থাকবে না এই সব নদী

জল কমে মরে যাহা আছে আজাবধি!

:::::::::::::::

বিবর্ণ মুখচ্ছবি

 

আপেল রঙের পৃথিবী আজ ঝুলে আছে

পঙ্কিলতা আর স্বার্থান্ধতার ফাঁসিতে।

রাঘব বোয়াল আজ গ্রাসী

খিল দাঁতে ফিকে হাসি

ছুটে যায় উন্মত্ত নেশায়

লোভাতুর বাঁশিতে।

 

নদী তীরে যার বসবাস

পাড় ভাঙা দেখে তার ওঠে নাভিশ্বাস

এই রাতে ভেসে যাবে নিবাসটুকু

বাঁচিবার নেই বুঝি আশ্বাস।

মলিন বদনখানি শুষে যায় বক্ষছাতি

ভেসে যেতে দেখে পাশ দিয়ে লাশ।

ওই পাড়ে পড়িতেছে চর

সেইখানে উঠিবে কালকেই ঘর

তাই দেখে কারও মুখে চিকন হাসি

নদী তোমারে কতো ভালোবাসি!

 

টোল পড়া গাল দেখে

জুড়েছিল মধুমাখা হাসি

বলেছিল সবটুকু আবেগ দিয়ে

তোমারেই শুধু ভালোবাসি

লুফে নিয়ে সুযোগে সবটুকু মধু

চুকে দেয় হিসেব-নিকেশ

ছুড়ে ফেলে পশ্চাতে বলে: সর্বনাশী।

একবার চলে গেলে দেখা পাওয়া ভার।

 

যদি চকিতে কভু দেখা হয়ে যায়

সহসা বিবর্ণ বদনে মলিন হাসি।

:::::::::::

 

বন্ধ্যা বিবেক

 

এখন আর আকাশের কোল ঘেঁষে

বাতাসেরা উড়ায় না ঘুড়ি

সৌন্দর্যের ব্যাকরণ রপ্ত করে

মাঝ বয়সী.... নারী

চলে নগরের শপিংমলে

আকাশ ছোঁয়া ছাদের কার্নিশে ওড়ে

সিনথেটিক অন্তর্বাস।

 

গোপন কামরায় কাগজের ফুলে

ওড়ে গেরুয়া রঙ এর ভালোবাসা

সাদা করার সুযোগে কালো অর্থের দাপটে

পেরনের আস্তিনে জমে না ময়লা নোট।

রাত বাড়ে ঘটি ভরা নেশার পিয়াতে!

মহোচ্ছফের কামুক গোঙ্গানীতে

দৌড়ে পালায় ক্ষুধার্ত নিশাচর।

 

বন্ধ্যা সমাজে বিবেকের সংকটে

স্বপ্নেরা ঘুমিয়ে থাকে চোখের চিমনিতে।

::::::::::::::

 

কবিতা আমার বিশ্বাসের প্রণয়িনী

 

যখন ঘুমাতে পারিনা

কবিতার সাথে করি সহবাস

পাশেই ঘুমায় সহধর্মিনী; শীতল নিঃশ্বাসে।

আমার মাঝে ভাঙে-গড়ে জীবন নদী

স্মৃতির উদ্যান পোড়ে দীর্ঘশ্বাসে।

 

আঁধারের বসন খুলে

ভোরের লাজুক আলো আমাকে ডেকে বলে:

একি সর্বনাশ!

আমি বলি: এ প্রণয় দেনমোহর ও কাবিন ছাড়া

শুধুই বিশ্বাস।

::::::::::::::::

 

শিকড় বিহীন সভ্যতা

 

সভ্যতার সিঁড়ি বেয়ে আজ আমরা

বড়ই নির্দয় স্থানে পৌঁছে গেছি।

যেখান থেকে শিকড়ের কথা ভাবার

একদম সুযোগ নেই আমাদের।

সভ্যতা নামের সুতীক্ষ্ণ করাতে

টুকরো টুকরো আজ একান্নবতি পরিবার।

বেহেস্ততুল্য জনক-জননী আজ বৃদ্ধাশ্রমে!

উপার্জনে নয়। কর্তৃত্বে পরিবারে প্রত্যেকেই

যেন উগ্র-মরিয়া সিঁড়ি ডেঙ্গিয়ে।

 

অর্থ আর ক্ষমতার দাপটে অসহায় আজ

আদি ভদ্র-গৃহস্থ বয়স্কজন।

সালাম আদাব ফেলে শিক্ষার্থীরা আজ

হ্যান্ডসেকে নেয় গুরুজনের কুশল

হাতের মুঠোয় ছেঁড়া ফাঁড়া নোট নিয়ে

বাজারের অলি-গলি ঘুরে

শূণ্য খুলোই হাতে ফিরে আসে

রিটায়ার্ড স্কুল মাষ্টার!

 

বিবেক আদালত না হোক, দেখো

প্রকৃতির প্রতিশোধে ভাঙবে একদিন

শিকড় বিহীন সভ্যতার সিঁড়ি।

::::::::::::

 

যদি বাঁশি আর না বাজে

 

যদি বাঁশি আর না বাজে

থেমে যায় সব চেনা সুর

তবে কি আসবে না কেউ জলের ঘাটে?

যদি সানাইয়ের সুর আর না বাজে

তবে কি কাঁদবে না কেউ নৈঃশব্দে

স্বজন ছাড়ার বেদনায়?

 

যদি আকাশ তার নীল হারায়

একটি তারাও আর না জ্বলে

ধ্রুপদী চাঁদের পাশে

তবে কি বসবে না কেউ বাতায়নে

আসবে না কেউ গোপন অভিসারে?

যদি কোকিলের কুহুতান থেমে যায়

তবে কি আসবে না ফাল্গুনী বসন্ত?

ফুটবে না ফুল? ভরবে না

সবুজ পাতায় বৃক্ষরাজি?

 

যদি কণ্টকাকীর্ণ হয় চেনা পথ

তবে কি পৌঁছবে না কেউ

প্রিয়জনের গন্তব্যে?

:::::::::::::

 

মানুষ মানুষের তরে

 

মানুষ মানুষের তরে, তাই

গাই মানুষেরই জয়গান,

পাঠাইলো বাণী প্রভু, তোমাদের

করে: সাম্যের আহবান।

 

মানব জনম বৃথা না যায় যেনো

কর্মে ফুটাও পুণ্য ফুল,

মিথ্যা ছেড়ে করো সত্যের লেনদেন

বিদ্বেষ ঘৃণা মোহমায়া সবি ভুল।

 

মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান

কিবা পুরুষ-নারী,

মসজিদ-মন্দির গীর্জা কিবা

চ্যারিটি মিশনারী।

 

সবাই মানুষ মানুষের তরে

একই প্রভুর সৃষ্টি সবে,

এই সুন্দর পৃথিবীর ‘পরে

মানুষে মানুষে কেনো দ্বন্দ্ব তবে?

 

আজকের বিজ্ঞান ছিলোনা যখন

মানুষ ছিল অসহায়,

মানুষই তখন মানুষেরে এসে

দিয়েছিল সব অভয়।

:::::::::::::

 

বিমূর্ত রাত্রি আমার, তোমার আয়োজনে

 

হরিদ্রি ফুলের সাথে মিশে যায় পড়ন্ত রোদের আভা

দুধ সাদা জোৎস্না প্লাবনে

ঢেউ খেলে যায় হৃদয়ের গহীন পাড়ে

বিষণ্ণ দুপুরে বিরহী ঘুঘুর ডাকে

কল্পনায় ডুবে যাই স্মৃতির অতলে

দৃষ্টির জালে ছেঁকে আনি সোনালী অতীত

বর্তমানকে আড়াল করি হতাশার পর্দায়

প্রজাপতির পরাগায়ণে দেখি ভবিষ্যতের অস্তিত্ব

যৌবনাবতি বাতাস দক্ষিণের জানালায় করে খেলা

বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া আকাশের কোল ঘেঁষে

শুভ্র মেঘের ভেলা ভেসে যায় দূর পাহাড়ের গায়

বেল আর ছাতান ফুলের মাদকতায়

গাঢ় নিঃশ্বাসে বুদ হয়ে বালিশে মুখ গুজি।

 

রাত্রির আহবানে ক্লান্তি নাশীতে নীড়ে ফিরা পাখি

পালকে মুখ গুজে ভুলে যায় দিনের কষ্ট,

তোমার বুকের ওমে মুখ গুজে আমিও খুঁজি শান্তি।

যখন আকাশের বুকে জেগে রয় একা চাঁদ আর

পৃথিবীকে গিলে খায় নিঝুম আঁধার।

 

হৃদয়ের কার্নিশে বুনি সুখ তারার বীজ

ভেজা চুলের গন্ধজলে পেতে রাখি নাসারন্ধ্রের ভেসাল

বৃষ্টির জলে ভাসাই কাগজের নৌকা

শিশিরের আয়নায় ভাসে সেই চেনা মুখ

বেহুলার সিন্ধুকে পাথরের ফুলে সাজাই বাসর

মখমলের ব্র্যা-তে যেমন ঢেকে থাকে আপেল নাশপতি

বুকের পশম আর চুম্বনে সেভাবেই জড়াবো তোমায়

এর পর চলে যাও; ক্ষতি নেই

কিবা সুখ-দুঃখের খেলায় হেরে যাই! দুঃখ নেই।

 

বিমূর্ত রাত্রি আমার

শুধু তোমার আয়োজনে।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন