অতুল প্রসাদ সেন : জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
শ্যামসুন্দর দেবনাথ
‘‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা
ভাষা’—কালজয়ী এই গীতিকবিতার স্রষ্টা, বাংলার গর্ব, শরীয়তপুরের অহংকার
অতুলপ্রসাদ সেন। তিনি ব্রিটিশ ভারতবর্ষে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভূত একজন অন্যতম
বিশিষ্ট কবি, গীতিকার, সুরকার, গায়ক ও বিখ্যাত সঙ্গীতবিদ। এছাড়া তিনি ছিলেন
রাজনীতিবিদ, শিক্ষানুরাগী, সাহিত্য সংগঠক, সমাজ সংস্কারক, ব্যারিস্টার ও প্রখ্যাত
আইনজীবী; মোটের উপর তিনি ছিলেন সংবেদনশীল উদারচিত্তিক মানুষ। তাঁর রচিত গানগুলোকে
বলা হয় ‘অতুলপ্রসাদী সংগীত।’ তাঁর গানগুলোর মূল উপজীব্য বিষয় হচ্ছে—দেশপ্রেম, ভক্তি ও প্রেম-বিরহ। নিজের জীবনের যন্ত্রণা ও
দুঃখগুলো তাঁর গানের ভাষায় ও ব্যঞ্জনায় বাঙময় মূর্তিধারণ করে আছে। ‘বেদনা অতুলপ্রসাদের
গানের প্রধান অবলম্বন।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর গানের অন্যতম একজন
গুণগ্রাহী। অতুলপ্রসাদ সেন রচিত ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’—অমর এই সঙ্গীতটি ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে)
বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। এই গানটির আবেদন আজও
অম্লান।
অতুলপ্রসাদ সেন পৈতৃক নিবাস শরীয়তপুর
জেলার নড়িয়া উপজেলাধীন মগর গ্রাম হলেও অতুলপ্রসাদের জন্ম হয় মাতুলালয়ে, ঢাকার ওয়ারিতে
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ২০ অক্টোবর। তাঁর মাতার নাম: হেমন্তশশী দেবী,
গৃহিণী এবং পিতার নাম: রামপ্রসাদ সেন, পেশায় চিকিৎসক। ঢাকায় মিটফোর্ড হাসপাতালের
কাছেই তাঁর চেম্বার ছিল। রামপ্রসাদ ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহভাজন; মহর্ষি
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রামপ্রসাদ সেনকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করতে সাহায্য
করেছেন। রামপ্রসাদের শ্বশুর ছিলেন ঢাকার বিখ্যাত ব্যক্তি ঋষি কালীনারায়ণ গুপ্ত। অতুলপ্রসাদ
সেন ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করে কলকাতার
প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে) ভর্তি হন এবং কিছুদিন
অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি লক্ষ্ণৌ চলে যান। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্যারিস্টারি
ডিগ্রি লাভের উদ্দেশ্যে লন্ডন গমণ করেন এবং পরবর্তী সময়ে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে
ফিরেন। আইন ব্যবসার স্বার্থে ব্যারিস্টার অতুলপ্রসাদ লক্ষ্ণৌ শহরেই বসবাস করেন। পিতা-মাতার চার সন্তানের
(০১ পুত্র ও ০৩ কন্যা) মধ্যে অতুলপ্রসাদ ছিলেন জ্যেষ্ঠ। যখন অতুলপ্রসাদের বয়স
মাত্র ১৩ বছর তখন তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মাতা সন্তানদের নিয়ে
লক্ষ্মীবাজারে পিতৃগৃহে গিয়ে ওঠেন। অতুলপ্রসাদ ব্যারিস্টার হয়ে এসে মামাতো বোন হেমকুসুমকে
অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বিয়ে করেন এবং কিছুকাল লন্ডনে ওকালতি করেন। এ সময়
তাঁদের যমজ সন্তান (দিলীপ ও নিলীপ) জন্ম হয়। সাত মাস বয়সে নিলিপের
মৃত্যু হয়। লন্ডনে তেমন পসার লাভ করতে না পারায় অতুলপ্রসাদ সপরিবারে লক্ষ্ণৌতেই
স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এবং আইন পেশায় অনেক নাম ও প্রতিপত্তি লাভ করেন।
অতুলপ্রসাদ প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য
সম্মেলন প্রতিষ্ঠাকালে তিনি অন্যতম প্রধান; সম্মেলনের মুখপত্র ‘উত্তরা’র অন্যতম
সম্পাদক এবং সম্মেলনের কানপুর ও গোরখপুর অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত
গ্রন্থ: ‘গীতিকুঞ্জ’, ‘কয়েকটি গান’ ও ‘কাকলি’ (পাঁচ খণ্ডে গানের স্বরলিপি)। বাংলা গানে সর্বপ্রথম ঠুমরি
আমদানির পথিকৃৎ তিনি। গানের সুরে কীর্তন, বাউল, তথা লোকসুরের প্রয়োগ এবং গ্রাম্য
সুর সংগ্রহ ও প্রয়োগ, সুরের প্রচলিত ঢং, গজল, দাদরা, লোকসংগীত ইত্যাদি অবলম্বনে
সুর রচনা করে তিনি বিশিষ্টতা অর্জন করেন।
অতুল প্রসাদ সেনের আর্থিক সাহায্য ও
প্রচেষ্টায় নড়িয়া উপজেলায় তাঁদের পৈত্রিক বাড়ির সন্নিকটে ‘পঞ্চপল্লী গুরুরাম উচ্চ
বিদ্যালয়’ ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। অতুলপ্রসাদের উইল থেকে এই ‘পঞ্চপল্লী
গুরুরাম উচ্চ বিদ্যালয়’ প্রতি মাসে ২৫ টাকা করে পাবে—তিনি সেই ব্যবস্থা
করে গিয়েছেন। সঙ্গীতজ্ঞ এই মহানুভব ব্যক্তি অখন্ড ভারতের লক্ষ্ণৌ শহরের ১৯৩৪
খ্রিস্টাব্দে ২৬ আগস্ট পরলোকগমন করেন। ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী হিসেবে অতুলপ্রসাদের
মৃতদেহ দাহ করে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয় লক্ষ্ণৌতেই। পরবর্তীতে তার চিতাভস্ম
গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলায় কাওরাইদ (কাওরাদি) ব্রাহ্ম মন্দিরের পাশে
সমাধিস্থলে এনে সমাহিত করা হয় । এখানে একটি স্মৃতিফলক ছিল যাতে লেখা ছিল ‘মোদের
গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা’। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্বর পাক
সেনারা গুলিবর্ষণ করে উক্ত ফলকটি ভেঙে ফেলে।পরবর্তীতে নতুন করে স্মৃতিফলক করা হয়।
নতুন স্মৃতিফলকে লেখা রয়ছে:
অতুল প্রসাদ সেন
জন্ম : ১৮৭১, ২০ অক্টোবর
মৃত্যু : ১৯৩৪, ২৬
আগস্ট
‘শেষে ফিরব যখন সন্ধ্যাবেলা সাঙ্গ করে
ভবের খেলা
জননী হয়ে তখন কোল বাড়ায়ে রবে
আমার সে শূন্য ডালা, তুমি ভরিয়ো
আর তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিয়ো।’
অতুলপ্রসাদ সেন লক্ষ্ণৌতে আইন ব্যবসার
পাশাপাশি সমাজ সেবামূলক বহু কর্মকাণ্ড করে গিয়েছেন, যা লক্ষ্ণৌবাসীরা আজও ভুলতে
পারেনি। তাঁর জীবদ্দশায়ই লক্ষ্ণৌ শহরের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে তার নামে। লক্ষ্ণৌ
বিদ্যালয়ে একটি হল তাঁর নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৫
সেপ্টেম্বর লক্ষ্ণৌ মিউনিসিপাল পার্কে অতুলপ্রসাদের একটি মর্মর মূর্তি স্থাপিত হয়।
লক্ষ্ণৌবাসীরা তাদের প্রিয় সেন সাহেবের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার লক্ষ্যে
অতুলপ্রসাদের এই মর্মর মূর্তি স্থাপন করে। এই মূর্তির পাদদেশে লেখা আছে:
To
The
memory of A.P.Sen Poet, Patriot, Lawyer, Philanthropist who gave his loving
services to all spheres of Life and Society. 20th Oct 1871. Erected by 26th
Aug.1934. Friends
‘দিল বঙ্গ বীণাপাণি অতুল প্রসাদ
চিত্ত জাগরণী গানে নিত্য আশীর্বাদ।’’
—রবীন্দ্রনাথ
সরকারের সুদৃষ্টির ফলে ২০১৫
খ্রিস্টাব্দে তাঁর একটি মুরাল প্রতিকৃতি পঞ্চপল্লী গুরুরাম উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপিত
হয় এবং ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই বিদ্যালয়ে ‘অতুল মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়। দুঃখের বিষয়,
দু-তিন বছর যাবত মেলা হচ্ছে না। অতিসম্প্রতি ‘ঢাকাস্থ শরীয়তপুর লেখক পরিষদ’ শরীয়তপুরের
দুই কৃতী সন্তান অতুলপ্রসাদ সেন ও আবু ইসহাক-এর স্মৃতি স্মরণার্থে ‘অতুলপ্রসাদ
সেন-আবু ইসহাক সাহিত্য পুরস্কার’ প্রবর্তন করেছে এবং কমপক্ষে পাঁচজন গুণীকে এবার
পুরস্কৃত করার জন্য মনোনীত করেছে।
তথ্যসূত্র:
১) অতুলপ্রসাদ সেন—বিশ্বজিৎ ঘোষ
২) মানুষ অতুলপ্রসাদ—পাহাড়ী সান্যাল
৩) উইকিপিডিয়া
৪) অতুলপ্রসাদ সেন—vikaspiedia
৫) সেন, অতুল প্রসাদ—বাংলাপিডিয়া
৬) গৌতম চন্দ্র দাস, প্রধান শিক্ষক, পঞ্চপল্লী
গুরুরাম উচ্চ বিদ্যালয়
৭) মিজানুর রহমান গ্রামসি, সভাপতি, ঢাকাস্থ
শরীয়তপুর লেখক পরিষদ
৮) গৌতম চন্দ্র গোলদার, সহকারী
শিক্ষক, পঞ্চপল্লী গুরুরাম উচ্চ বিদ্যালয়।
লেখক
পরিচিতি:
শ্যামসুন্দর দেবনাথ। ১০ ফেব্রুয়ারি
১৯৫৫ পালং, শরীয়তপুরে জন্মগ্রহণ করেন। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা প্রচারবিমুখ,
সদালাপী, ইতিহাস ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতির উপকরণ সংগ্রাহক ও গবেষক এই শুভজন এ যাবৎ
অসংখ্য কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, গল্প, চুটকি, রম্যরচনা, গান ও উপন্যাস লিখেছেন।
তিনি শরীয়তপুরে বহু সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি বহু সাহিত্য-সাময়িকী ও সংকলন সম্পাদনা করেছেন। লোকজশিল্পে অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন—‘জাতীয় সাহিত্য পরিষদ শরীয়তপুর’ জেলা শাখা পুরষ্কার—২০১৪। এছাড়াও অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন।