কবি শাহ জালাল মিয়ার একগুচ্ছ কবিতা
আমার
শৈশবের কিছুক্ষণ
শৈশবকে খুঁজতে খুঁজতে একদিন...
রুপালি ডানার পঙ্খিরাজে চড়ে সুবর্ণ গ্রামের স্মৃতিদের
বাগানভিটায় পৌঁছলাম।
দেখি, ওপাড়ার হাশেম-কাশেমরা সাদা কুয়াশার ভোরে পোড়াকাঠের আগুনে
হাত-পা শরীর সেঁকে নিচ্ছে,
আর তাপে ওদের হাত, পা, মুখ পুড়ে লাল আলো ছড়াচ্ছে;
আমি হেঁটে হেঁটে ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
ওরা আমাকে মাঘেরশীতে মহিষডাঙার বিলে ‘পলো’ দিয়ে
নীল রঙের মাছ ধরার অচিন এক গল্প শুনালো,
আর শুনালো, নাড়ার আগুনে হাত-পা পুড়িয়ে লাল করে নেয়ার গল্প।
কুয়াশার ধোঁয়াশা কাটতেই
পূর্বাকাশে একটা লাল টকটকে কুসুমসূর্য দেখা দিলে,
খাবার ভেবে খেতে চাইলে হাশেম-কাশেম’রা বলে উঠল,
সে কি! ওটাতো ভোরের সূর্য, কাঁচা আগুন! ওটা কি খাওয়া যায়?
খেলে তো, তোর শরীরের সব সীসা গলে মাটিতে মিশে যাবে,
তখন হাঁটবি কি করে?
আমি হেঁটে হেঁটে হাতেম গাছির বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম
হাতেম আমাকে স্বচ্ছ, তাজা এক গ্লাস খেজুররস খেতে দিল
আমি সেই অমৃত এক চুমুকেই খেয়ে ফেললাম।
সে তখন বলল, এখন তুই অন্ধকারেও বাদুরের মতো উড়তে পারবি।
একটু এগিয়ে দক্ষিণের মগদম হাজীর ছনভিটায় যেতেই
দেখি—লাবণ্য, ললিতা,
লতিফা ওরা সরষেক্ষেতের পাশে বসে রোদ পোহাচ্ছে
আমাকে দেখে ডেকে বলল, ‘আয় তোর মুখে সরষে ফুলের হলুদ মেখে দেই,
আমাদের মতো হলুদ হয়ে যাবি,’
তখন সবাই তোকে ‘হলুদ পাখির ছানা’ বলে ডাকবে
আমাদের সাথে চল্, তোকে আড়িয়াল বিলের লাল পদ্ম এনে দেব।
আর এনে দেব, চানকা বিলের শোলার ফুল, কাজী ভিটার পাকা পেয়ারা,
ঘোষেদের মিষ্টি কুল।
জয়গুনের মা বললেন, সোমত্ত মেয়েদের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে নেই আমার
বাড়ি এসো,
তোমাকে কাউনের চালের মিষ্টান্ন খাওয়াব, সাথে বাদাইধানের মুড়ি;
মা ডেকে বললেন—কোথায়
ছিলি এতোক্ষণ?
তোর জন্য আমি চিতুই পিঠা বানিয়ে রেখেছি
রেঁধেছি ভাত, ভর্তা আর মাগুর মাছের ঝোল
সব খেয়ে উঠোনে নামতেই দেখি ভোরের ঘোর কেটে গেছে
আছে শুধু আলো আর আলো
সে আলোয় বাসায় ফিরতেই এরা খেতে দিল সেই চা কফি ব্রেড-বার্গার,
হাতে ধরিয়ে দিল চকচকে লম্বাটে একটা চাবির বাটন
যার প্রতিটি স্পর্শে জেগে ওঠে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ-
অসংখ্য ছবির এ্যালবাম স্পষ্ট স্থির,
অথচ অচেনা অদ্ভুত কিম্ভুত কিমাকার
অগত্যা ওসবই খেতে থাকলাম।
………………….
প্রতিনিয়ত প্রতিবিম্বের সাথে পথচলা
ঝড়েপড়া মৃতকোষের ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে হাঁটতে থাকি দিনভর
যত্রতত্র, যখন
তোমার শরীর থেকে বিচ্ছুরিত আলোকবিন্দুগুলোকে জড়ো করি একত্রে
সাজাই-সজ্জায় সাজপত্রে। অতঃপর একটি মূর্ত অবয়ব গড়ে তুলি মনের
ভেতর, সেই অবয়বের সাথেই কথা বলি গল্প করি হাসি খেলি রঙ্গ করি।
এসব করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে যাই তখন কিছুক্ষণের জন্য মঞ্চ
ছেড়ে বিশ্রামঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেই; আরাম আয়েশ করি, ঘুমাই, অথচ
এই ‘আলো’দের কোনো ঘুম নেই, আরাম-আয়েশ নেই বিশ্রামও নেই,
ওরা শুধু বয়েই চলে বয়েই যায়। রেখে যায় অগণিত প্রতিবিম্বের
বুদ্বুদ।
যা অবয়ব হয়ে সচল রাখে জগৎ ও জীবনকে। আর এভাবেই চলতে
থাকে অগণিত প্রাণের এক অফুরন্ত মেলা; তৈরি হয় এক একটি মহাকাব্য,
এক একটি উপাখ্যান।
…………
অগ্রসরমান
সময় ও জীবন
(সহোদর মিজানুর রহমানকে)
অগ্রসরমান সময়গুলো স্থবির হয়ে হয়ে এক সময়
স্থিরচিত্র বনে যায়—
শুধু সম্মুখে তাকিয়ে থাকে
মৃত কাঁকড়ার খোলস থেকে বেড়িয়ে আসে
কাঁকড়াছানার দুরন্ত ‘স্কোয়াড’
যখন দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে
বাড়ন্ত ছানারা হামাগুড়ি দিয়ে সম্মুখে এগোতে থাকে
প্রেতপুরীর জঞ্জাল ঠেলে সামনে যেতে
ক্রমে শক্তি হারায় ওরা—
স্পন্দন ক্ষীণ হয়, মৃত কোষ ঝরে পড়ে
প্রজন্ম রেখে একসময় ওরাও অতীত হয়ে যায়
সময় এগিয়ে যায় অগ্রসরমান নতুন সময়ের হাত ধরে
মৃত্যুর খোলস থেকে বেড়িয়ে আসে
সম্ভাবনার সব নতুন জীবন।
……………………….
আজও
বৃষ্টিহীন মেঘের মতো স্বপ্নহীন আমি
দামোদিনী নদীর প্রবল স্রোতে ভাসতে ভাসতে
গাঙ্গুর, কালিগঙ্গা হয়ে শেষে
জ্যোৎস্নারাণীদের স্নানঘাটের মুখর মোহনায় থমকে গিয়ে দেখি নেই!
আমার শৈশবের জলখেলার সেই সঙ্গীরা কেউ নেই!
বা পাশের আধডোবা সাদা কাশফুলের বুনোঝাড়গুলো নেই কিংবা
ডান পাশে ন্যুয়ে থাকা হিজল তমালের সহিষ্ণু ডালগুলোও নেই!
যে ডাল থেকে ওপাড়ার ডানপিঠে ছেলেরা অদ্ভুত ভঙ্গিমায়
ঝাঁপিয়ে পড়তো জোয়ার জলের ঘোলা স্রোতে।
ভেসে আসা অচিন ফল নিয়ে ‘জলদাপি’ খেলার সেই দুরন্তপনা নেই!
প্রবল স্রোতের উজানে আওলাদ সাহাদতদের সাঁতরে যাওয়ার দুর্দান্ত
সাহসিকতাও নেই!
কিংবা ওপাড়ের দাসেদের ঘাটে ঢোল সানাইয়ের ফাঁকে
নববধূটির জল তোলার দৃশ্যটিও নেই
নদীপাড়ে হাঁটতে থাকা সন্ধ্যাদেবীর রুপালি দাঁতের
বেগুনি হাসিটিও নেই
আছে শুধুই এক নিরবতা! নিষ্ঠুর নীরবতা!
নিঃসঙ্গতা—
নির্মম—নিঃসঙ্গতা!
………….
আর
কতো বিব্রত হবে
ড্রাগনের কঙ্কালে জেগে থাকা অজস্র লাশের গন্ধ
প্রেতাত্মার বিষাক্ত নিঃশ্বাস
অজানা আতংক
আমাদের আর কতো কাঁদাবে বলো?
এখনো টগবগে যুবকের শ্লোগান মুখর
রক্ত পলাশ হাতের জ্বলন্ত মশাল
রূপছায়ার গলির মোড়ে
লুষ্ঠিত শূন্যতায়
আর কতো পালাবে তুমি?
আর কতো বিব্রত হবে সত্যের যাত্রায়?
...........................................
প্রাগৈতিহাসিক
পরিমন্ডলেই আছি
প্রাগৈতিহাসিক পরিমন্ডলেই আছি
রাতে দেয়ালে তাকাই—
দেখি
গিরগিটির
লেজনৃত্য শিকারী জীবের নখ
লোভীর লাল চোখ
লকলকে জিহ্বায় লিপ্সার চিহ্ন
পোষা নেকড়ের ডাকে ঘুম থেকে জাগি
বুনোমোষ
বনগরু উঠোনেই বাঁধা
ড্রাগন গুইসাপেরা জঙ্গলে ঘুরেফিরে একা
সাপেরা শিকার খোঁজে জলে ও ডাঙ্গায়
ডায়নোসর ডানা মেলে
উড়ে যায়
দূর নিলীমায়।
প্রাগৈতিহাসিক পরিমন্ডলেই আছি
দুর্বল মানুষ
বড় অসহায়!
.............
পথের
সন্ধানে
দিন পোহালে কাঁকড়ার গর্তে ঢুকি
আঁকা বাঁকা, বন্ধুর সুড়ঙ্গ পথ
অদ্ভুত অলিগলি, গর্তের শেষে গর্ত দেখি
সুরঙ্গের সীমান্তে নতুন সুড়ঙ্গ আবার পাই
—পথ খুঁজে পাই না।
রাত পোহালে গর্তের বাইরে আসি
—সূর্যালোক, মসৃন ময়দান, বিস্তীর্ণ সড়ক দেখি
ছন্দহীন, লক্ষ্যহীন এলামেলো এবড়োখেবড়ো
পদচিহ্ন পাই—
—খুঁজেও পথ পাই না
সমুদ্র জানাল, “পথ খুঁজতে সৈকতে নয়
ডাঙায় পিঁপড়েকে দেখ
ওরা পথে চলে, পথে হাটে, পথ বানায়
আকাশে পাখিরাও ঠিক পথে ওড়ে,
সীমাহীন শূন্যেও পথ খুঁজে পায়
কিছু মানুষও আছে যারা পথ চিনে পথ খোঁজে
—পথ রেখে যায়”।
.... .... .... .... ....
পরিবর্তন
তত্ত্ব আর মতলববাজিকে এক পাল্লায় তুলে
ঘোলা জলে মৎস্য শিকারে পারঙ্গমতা
শৃগালিক চতুরতায় তামাকে সোনা
বানানো যায় যদিও।
তবু কষ্টি পাথর সময়ে সত্য বলে দেয়
সত্য আর মিথ্যার মাঝে যে ফারাক তা জানতে
পুরাণ ঘাটতে হয় না
‘কাল’ কে দোষ দিয়ে কী লাভ?
যদি না আমিই আমাকে পাল্টাতে পারি।
.... .... .... .... .... .... .... .... ....
আপনজন
মামুদ পট্টির মাঠে পল্লবিত হিজলবৃক্ষটির তলায়
বসে একদিন যখন তিলফুলে মৌমাছির বৃন্দনৃত্য দেখছিলাম
তখন ডালে বসা হলুদ—নীল
অচেনা পাখিটি জানতে চাইল,
‘কে তোমার আপন বল’?
কিশোর আমি, তাই মাকেই আপন জানালাম।
বয়স বিশ যখন যুবক আমি হিজলতলায় বসতেই পাখিটি
আবার প্রশ্ন করল
‘এখন কে তোমার আপন বল’?
আমি আমার ভালবাসার প্রিয় নামটিই উচ্চারণ করলাম
আজ চল্লিশে এসে সেই পাখিটির প্রশ্নে নির্দ্বিধায়
সন্তানের নামটিই বলে দিলাম
.... .... .... .... .... .... ....
ভয়রা
নদীর পাড়ে
ভয়রা নদীর স্বচ্ছ জলে ডুবসাঁতার কাটছিল যে কিশোরী
তার স্বপ্নিল চাউনির অর্থ খুঁজিনি সেদিন
বটের ছায়ায় মাদুর পেতে বসা বৃদ্ধাটির বিশ্রামের অনুরোধে ও
সাড়া দেইনি
নদীপাড়ের মাঠে মটরশাকে মুঠি ভরছিল যে যুবতী
তার উদাস দৃষ্টির অর্থটি ও খোঁজা হয়নি সেদিন
চঞ্চল এক কিশোরের স্নানের আহ্বানটিও নেই নি তখন
কর্মব্যস্ততার চলন্ত ট্রেন সামনে টেনে নিয়েছে আমাকে
আজ অবসরে ভয়রা তীরে এসে সেই বৃদ্ধা, বালিকা,
কিশোর কিংবা, যুবতী কাউকেই দেখতে পেলাম না
স্বচ্ছ জলের সেই নদীটিরও হদিস নেই
সবুজ শস্যের মাঠটির সবুজ সৌন্দর্য ও নেই।
..... ..... ..... ..... ..... ..... ..... .....
দিন
দিন অচেনা হয়ে উঠছি
ফেলে আসা দুরন্ত কৈশোর...
স্মৃতিময় সেই চৈত্র মেলা...
পদ্মদীঘিপাড়ে অশ্বথ তলায় জমে ওঠা
বিকিকিনির অজস্র পশরা
শব্দ ও সুরের মন্থনে জেগে ওঠা অষ্পষ্ট মধুর গুঞ্জন
আজও শব্দহীন নিস্তব্ধতার সিঁড়ি ভেঙ্গে
সড়কসঙ্গমে এসে,
এক মায়াবাস্তবতার জালে আমাকে আবিষ্ট করে
আচ্ছন্ন করে-নিমগ্ন করে এক বিষণ্ণ সুন্দর মোহময়তায়,
এক পশলা শব্দহীন নির্ভেজাল, নির্মল
শান্তির পরশ বুলায়
একান্ত আতিথেয়তায়।
…………....
বিজয়
বুঝিনা
বিজয় বুঝিনা,
কারণ, পরাজিতরা দখল ছাড়েনি
এখনও।
স্বাধীনতা জানি না,
কারণ মানুষরা মুক্তির স্বাদ পায়নি
মোটেও।
লেখক পরিচিতি : কবি শাহ
জালাল মিয়া ০১ অক্টোবর ১৯৬১ সালে শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলাধীন আদাসন গ্রামে
জন্মগ্রহন করেন। প্রকৃতিপ্রেমী ও প্রগতিবাদী কবি গ্রাম-বাংলার বৈচিত্রময় প্রাকৃতিক
নৈসর্গে কাটিয়েছেন শৈশব ও কৈশোরের। যা তাঁকে একটি সমৃদ্ধ কল্পনার জগৎ উপহার দিয়ে জীবনমুখী
চেতনায় পরিপুষ্ট করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায়নকালে প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব,
কবির সাহচর্য এবং কর্মজীবনে শরীয়তপুরের স্থানীয় কবি সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে তাঁর
লেখনী গতিশীল হয়ে ওঠে। পাশাপাশি তরুণ
প্রজন্মকে বাঙালী সংস্কৃতি, বাংলা সাহিত্যচর্চা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুরাগী করে
তুলতে বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত আছে। তাঁর
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ভাবনার বহুব্রীহি’ এবং স্বা‘ধীনতা সময় স্মৃতি’।