মির্জা হজরত সাইজী’র একগুচ্ছ মন মাতানো ছড়া
শিশু
এমন একটি শিশু আছে
কে যাবে সেই শিশুর কাছে
যে শিশুটির জামা নেই
খালা কিংবা মামা নেই
গানের সা-রে গা-মা নেই
দুঃখ কাঁদা থামা নেই।
এমন একটি শিশু আছে
কে যাবে সেই শিশুর কাছে
যে শিশুটির মা-ও নেই
চলার দুটি পা-ও নেই
কষ্ট কাজে না-ও নেই
নির্যাতনে রা-ও নেই।
এমন একটি শিশু আছে
কে যাবে সেই শিশুর কাছে
যে শিশুটির খেলা নেই
ঘুরতে যাবার বেলা নেই
মন আকাশের ভেলা নেই
সঙ্গী-সাথির মেলা নেই।
এমন একটি শিশু আছে
কে যাবে সেই শিশুর কাছে
যে শিশুটি মেশিন ঘুরায়
আস্তাকুঁড়ে খাদ্য কুড়ায়
শীত পোহাতে পাতা পোড়ায়
দুখের জীবন দুখেই গড়ায়।
আমার লেখা ছড়াগুলো সেই শিশুদের জন্যে
উঠলো কেঁদে, যাবেই বা কে খুঁজল হয়ে হন্যে
মেঘ বলেছে আমি যাব
ফুল বলেছে আমি যাব
যাবে পাখির ছা
তোমরা যারা ছোট্টমণি
অবুঝ মনে সোনার খনি
তোমরা যাবে না?
…………..
লিটুর
মামা
লিটুর মামা মস্তগামা
পেটটা যে তার ইয়ে
চলার সময় পেট নিতে হয়
চাক্কা গাড়ি দিয়ে।
সকালবেলা খায় যে মামা
আট মোরগের রোস্ট
বারো ডজন রুটির পরে
একশোখানা টোস্ট।
দুপুরবেলা লিটুর মামা
উদর ভরে খান
গোস্ত পোলাও মুড়িঘণ্ট
খেয়েই ধরেন গান।
বিকেল হলে নিজেই বলে
এখন খাব কম
আষ্ট কেজি রসগোল্লা
একশোটা চমচম।
খেতে খেতেই লিটুর মামার
বাড়ছে শরীর পেট
তবুও মামা হাঁক ছেড়ে কন
আন ভেজে মামলেট।
ঘোড়ার ডিম
শুনতে পেলাম খাঁটি সোনার
ডিম পাড়ে তিন মোরগে
সে ডিম পেতে ছাতা নিয়ে
নেতার পিছে ঘোরো গে।
অনেক খুঁজে এক বিকেলে
পেলাম নেতার বাড়িটা
নেতা তখন দাঁড়িয়ে আছে
থামিয়ে রেসের গাড়িটা।
সেদিন থেকে নেতার সাথে
হলাম নেতার পাণ্ডা
মনের আশা একটা শুধু
সেই মোরগের আণ্ডা।
সকল কম্ম ফেলে রেখে
নেতার পিছন ঘুরি রে
বাড়ির কেহ ডাকলে বলি
ধুত্তুরি ধুত্তুরি রে।
অবশেষে চেতন এলো
দাদুর পরামর্শে
চেয়ে দেখি নেতার বাড়ি
ডিম পাড়ে দুই অশ্বে।
…………..
রাঙা
বিকেল
বালুর বুকে চিন্নালতা
মাঝে মাঝে হোগলা পাতা
বাড়ির পরে বাড়ি।
বাড়ির পিছে কবরি কলা
ধান-কাউনের লম্বা গলা
সবুজ সারি সারি।
সেই সবুজের চেলিজুড়ে
নাচছে ফড়িং উড়ে উড়ে
শালিক বাঁধে ঝাঁক।
কাশের পরে কাশের বন
বাতাস বাজে শনার শন
বানাডুলির পাক।
রাঙা মেঘের বিকেল বেলা
প্রজাপতির রঙিন মেলা
হলদে পাখি কই?
হলদে পাখি পুকুর ঘাটে
খুকুর মাথায় বিলি কাটে
সে তো খুকুর সই।
…………..
গাঁয়ের
ছবি
পুকুর পাড়ে নদীর ধারে
মামার বাড়ি কাকার বাড়ি
বাড়ির পিছে ঘন সবুজ
গাছ-গাছালি সারি সারি।
সবুজ-শ্যামল গাছের মাথায়
কালো মেঘের বাড়াবাড়ি
মেঘের লেপা আকাশ ছুঁয়ে
বক উড়ে যায় সারি সারি।
এরই মাঝে চতুর্দিকে
আঁধার ঘনায় কাঁড়ি কাঁড়ি
শেষবিকেলে আকাশ ভেঙে
বৃষ্টি নামে মুষল ভারি।
রাঙা পালের ডিঙি নৌকা
ছোট্ট নদী দেয় যে পাড়ি
মাঠের গরু সঙ্গে নিয়ে
রাখাল ফেরে চাষির বাড়ি।
ঘন মেঘের দাপট দেখে
সূর্য ডোবে তাড়াতাড়ি
ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালে
গাঁয়ের বধূ কিষাণ নারী।
…………..
পাখি
সভা
জঙ্গলে পাখিদের পাখি সভা হবে
দল বেঁধে উড়ে উড়ে গিয়েছিলো সবে।
পেঁচা ছিল সভাপতি গম্ভীর মুখ
লেকচার দিচ্ছিলো শালিক ডাহুক।
সভা পরিচালনায় ছিলো দাঁড়কাক
মঞ্চের সম্মুখে পাখি ঝাঁক ঝাঁক।
বকবুড়ো শুনছিলো গালে রেখে হাত
ময়নার কথা শুনে সকলেই মাত।
তালগাছে বসে বসে বাবুইয়ের দল
মন দিয়ে শুনছিলো নেই কোলাহল।
কোকিল আর বুলবুলি গাইছিলো গান
তাই শুনে ফিঙের বাড়ে আনচান।
বিল থেকে চিল এসে ঘুরে চারপাশ
মাছরাঙা গলা ভাঙা দেয় খুক কাশ।
ছানা কোলে মা পাখিরা শুনছিলো নীড়ে
পশুরা-ও যোগ দেয় এসে ধীরে ধীরে।
টুনটুনি কাকাতুয়া দোয়েল চড়ুই
শিষ দিয়ে বলছিলো মধুর বড়ুই।
গাছ পালা নেড়ে ডালা বলে বেশ বেশ
সুখের আবেশ নিয়ে সভা হয় শেষ।
…………..
ফিরে
আসি
আমি যদি আবার ফিরে আসি
নিশ্চয়ই আমি আসব আবার ফিরে
আমি যেন অথই সুখে হাসি
আমি হাসব ওকেই ঘিরে।
আমি যেন হাজার বছর ধরে
আমি যেন জনম-জনম ভরে
কুমড়ো ফুল আর উশশি লতা হয়ে
লাউয়ের ডগায় একলা যাবো রয়ে
আমি যেন আবার ফিরে আসি
দুখি মাগো তোমায় ভালোবাসি।
আমি যদি আবার ফিরে আসি
ঠিকই আমি আবার আসব ফিরে
খুঁজব আমি লাল ঘুড়িটা আবার
স্বপ্নগুলো খুঁজব পাখির নীড়ে।
আমি যেন আকুল ব্যাকুল হয়ে
হারিয়ে যাওয়া শৈশবেরে লয়ে
ঘাসফড়িঙের পিছন পিছন ধাই
কণ্ঠ ছেড়ে রাখালি গান গাই।
চোখের জলে বুক ভাসিয়ে হাসি
মাগো আমি আবার যেন আসি।
…………..
মেঘবালিকা
মেঘবালিকা মেঘবালিকা
কোথায় তুমি আছো
বাংলাদেশের আকাশ জুড়ে
চুল ছড়িয়ে নাচো।
মেঘবালিকা মেঘবালিকা
তোমায় ভালোবাসি
কদম ডালে ফুল ফুটবে
দেখলে তোমার হাসি।
মেঘবালিকার বেণী থেকে
ঝরবে বৃষ্টি জল
টেংরা, পুঁটি নাচবে সুখে
পেয়ে নতুন ঢল।
মেঘবালিকা মেঘবালিকা
আমার দাওয়াত নিও
ভরা কলস উপুড় করে
জলজ ডাকটি দিও।
মেঘবালিকা মেঘবালিকা
তোমার সজল রঙে
ভিজব সবাই নাচব সবাই
আষাঢ় মাসের ঢঙে।
মেঘবালিকা মেঘবালিকা
পেয়ে তোমার সাড়া
সবুজ চেলি মেলবে পেখম
নবীন গাছের চারা।
মেঘবালিকা মেঘবালিকা
কোথায় তোমার বাড়ি
আষাঢ় জুড়ে না আসলে
তোমার সঙ্গে আড়ি।
মেঘবালিকা মেঘবালিকা
তোমার সাথি কই
সময় করে না আসিলে
কাঁদবে তোমার সই।
মেঘবালিকা মেঘবালিকা
কানে ফুলের দুল
তোমার সাথে জুঁই, চামেলি
হেসেই না পায় কুল।
মেঘবালিকা মেঘবালিকা
বৃষ্টি নামার শেষে
চুলের খোঁপা শুকিয়ে নিও
মিষ্টি রোদের দেশে।
মেঘবালিকা মেঘবালিকা
তুমি আমার মিতা
রংধনুটি বেঁধে দেব
তোমার চুলের ফিতা।
…………..
মা
সবার চেয়ে আপন যেজন
সে যে আমার মা
মা যে আমার পরশমণি
বেহেস্ত মায়ের পা।
মা-ই আমার প্রথম ছবি
প্রথম কন্ঠস্বর
মা-ই আমার বর্ণমালার
সুবর্ণ অক্ষর।
মধুর চেয়ে আরও মধুর
আমার মায়ের বোল
জগতজুড়ে নেইতো কোথাও
এমন স্নেহের কোল।
অসুখ-বিসুখ দূর হয়ে যায়
মায়ের যতন পেলে
দুঃখ-কষ্ট সব ভুলে যাই
মায়ের কাছে গেলে।
আমার মায়ের আঁচল ঢাকা
আদরমাখা উমে
শীতার্ত রাত পার হয়ে যায়
স্বপ্নভরা ঘুমে।
পথের যেমন শেষ থাকে না
নদীরও নেই শেষ
তেমনি আমার মায়ের কথা
গল্প-স্মৃতির রেশ।
মায়ের কোলে বসে শিশু
মিটিমিটি হাসে
ইহার চেয়ে মধুর ছবি
কোন জগতে আছে?
থাকলে থাকুক সেসব আমি
রাখব শিকেয় তুলে
মাকে নিয়েই থাকব আমি
বাংলা মায়ের কোলে।
খোদার দেয়া দান জননী
স্বর্গসুধা মা
মাকে ছেড়ে দূর মুলুকের
কোথাও যাব না।
স্মৃতিগুলো মধুর বড়ো
মাকে আমার নিয়ে
ইচ্ছে করে লিখি সেসব
সোনার কলম দিয়ে।
…………..
শিয়াল
বিয়ে
লাল টুকটুক প্রভাত বেলায়
কাঁচা-মিঠা আলোর মেলায়
পুব আকাশে রাঙা লাটিম ঘুরছে।
ইতল-বিতল ঝোঁপের তলে
কুমড়ো ফুলের নরম দলে
ভোঁ ভোঁ ভোঁ কালো ভোমরা উড়ছে।
ফুর ফুর ফুর উদাস হাওয়া
শালি ধানের গন্ধ পাওয়া
মৌ মৌ মৌ ছুটছে।
কড়ুই কাঠের পুলের পাড়
দীঘল বেনু বাঁশের ঝাড়
পুঁই পুঁই ফুল ফুটছে।
বাড়ির পাশে চিকন খাল
সকাল বিকাল মাছের জাল
জেলেরা সব ফেলছে।
এদিক-সেদিক ছুটছে নাও
পাল তুলেছে বায়ুর ভাও
কোথাও নাও আটকা পড়ে ঠেলছে।
এই এলো রোদ এই বৃষ্টি
শিয়াল বিয়ে কী যে মিষ্টি
ঝির ঝির ঝির গাছের পাতা দুলছে।
পুকুর পাড়ে বধূর পা
কলাপাতায় ঘেরা গাঁ
ঘেকড়-ঘুকড় ব্যাঙের গলা ফুলছে।
………………
পাখির
অভিশাপে
এক দেশে এক রাজা ছিল ভীষণ অত্যাচারী
রাজার সেপাই মারতো প্রজা গিয়ে বাড়ি বাড়ি
দিতই নাকো খাবার-দাবার রাখত অনাহারী।
রাজ্যজুড়ে ভয়ের বাতাস বইত দুখের ঢেউ
রাজার ভয়ে কোথাও কিছু বলত না যে কেউ
কিছু বললেই ধরে নিতো রাজার ছদ্ম ফেউ।
একদিন সেই রাজা মশায় মন মাতানো রঙ্গে
বনে গিয়ে পাখির সঙ্গে উঠল মেতে জঙ্গে
সৈন্য-সেপাই বৃদ্ধ উজির ছিল রাজার সঙ্গে।
নির্বিচারে মারল রাজা পাখি হাজার কুড়ি
ফুল-পাখিদের সুখের বনে নামল যমের পুরী
রাজা বলে মিটল না সাধ, ধুত্তুরি! ধুত্তুরি!
রাজার চর বলল হুজুর ঐ যে ঝোঁপের ধারে
শুকসারি দুই বসে আছে ছাতিম গাছের আড়ে
বলছে কথা মনের সুখে লেজটি কেমন নাড়ে।
তীর-ধনুকে তাক করলেন রাজা যম শিকারির বেশে
কী ভেবে যে হঠাৎ উজির দিলেন কেঁদে-হেসে
রেগে যে রাজা বলল 'উজির একি সর্বনেশে'।
করজোড়ে বলল উজির, গোস্তাকী মাফ হয়
রাজা যদি আদেশ করেন বলতে সুনিশ্চয়
অভয় দিলেই বলতে পারি শুকসারি কী কয়।
বলছে শুকসারির নামে রাজ্য আধেক লিখি
দিবে দিয়ে যদি প্রেম থাকে অনন্তকাল টিকি
বাকি কথা বলতে হুজুর কাঁপে ধিকিধিকি।
সবুজ বনের অবুঝ পাখি যেই কথাটি কয়
সেই কথাটি বলতে হুজুর কতই লাগে ভয়
পাখির অভিশাপে আপনার মরণ সুনিশ্চয়।
এতেক শুনেই রাজার গায়ে উঠল ভীষণ জ্বর
ঘোড়ার পিঠেই বসে রাজা কাঁপেন থরোথর
কাঁপতে কাঁপতে চলে গেলেন যেইখানে শেষ ঘর।
রাজ্য বাঁচল হাসল উজির হাসল নরও নারী
সুখের বাতাস জুড়িয়ে দিল প্রজার বাড়ি বাড়ি
সেই সুখেতে নাচল বনের ফুল পাখি শুকসারি।
………………………
ইশকুলে
চলে যাই
ঘুম থেকে উঠে ভাবি
সারাদিন খেলব
খেলা শেষে খালে নেমে
নাওখানি ঠেলব।
জলকাদা মেখে গায়ে
ছোট মাছ ধরব
নানাপদ মাছ দিয়ে
কোচটারে ভরব।
মাঠে গিয়ে চেয়ে দেখি
চারিদিকে কেউ নাই
নদীপাড়ে গিয়ে দেখি
কোলাহল ঢেউ নাই।
বাড়ি এসে মাকে বলি
কী যে করি বলো মা
আম, জাম, পিঠা খাব
মামাবাড়ি চলো, মা।
মামাবাড়ি কেউ নেই
ঘরদোর ফাঁকা সব-
ডাক্তার দেখাবারে
চলে গেছে ঢাকা সব।
অবশেষে কী বা করা
একা একা তুলে হাই
সুবোধ ছেলের মতো
ইশকুলে চলে যাই।
…………..
রেলগাড়ি
রেলগাড়ি ঝমঝম
জোরে জোরে ছাড়ে দম
চলে বেশি থামে কম
ধোঁয়া ওড়ে হরদম।
রেলগাড়ি আগে যায়
ডানে বাঁয়ে নাহি চায়
গ্রামগুলো পিছে ধায়
মাঠ দূরে মিশে যায়।
কী যে মজা রেলগাড়ি
ছুটে চলে তাড়াতাড়ি
ছেড়ে কত ঘরবাড়ি
মাঠ-ঘাট দেয় পাড়ি।
এক দুই হাততালি
ধান-পাট মাঠ খালি
শানবাঁধা ঘাট খালি
তারপর-ই চাটখালি।
থামো থামো রেলগাড়ি
এসে গেছি মামাবাড়ি।
লেখক
পরিচিতি : মির্জা হজরত সাইজী প্রকৃত নাম
মির্জা হজরত আলী। নামের সাথে জন্মদাতার অস্থিত্বটুকু জড়িয়ে রাখার জন্য সাইজী
শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। জন্ম: ১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৭। পদ্মানদী পরিবেষ্টিত শরীয়তপুর
জেলার জাজিরা থানাধীন কান্তাইসার গ্রাম। উধাও আকাশ আর খোলা মাঠে উড়ালদৌড় শেষে থই
থই নদীতে সাঁতার দিয়ে কেটেছে শৈশব। তারপর পঁয়ত্রিশ বছরের রাজনীতি মেঠোকর্মী আর
বাইশ বছরের আইনপেশা নিয়ে চর আর নদীর মতোই পুরো জীবনটা ভাঙাগড়া। জীবনের হেলানো
বেলায় এসে লেখালেখির ব্যর্থ প্রয়াস। রাজনীতি, আইনপেশা আর লেখালেখি সর্বত্রই ‘না
পারিলাম বাঁচতে আমি না পারিলাম মরতে’ অবস্থা। শখ গান শোনা আর প্রকৃতির মাঝে বিলি
দেওয়া।
প্রকাশিত গ্রন্থ : এসো পাষাণ দ্রবীভূত হই (১৯৯৬), পাখির ডাকে দিলাম সাড়া
(২০০৮), বালিকা রমণী হতে চায় (২০১৬), রাজনীতির কবি (২০২১), গাঁয়ের কোলে পরান দোলে
(২০২১) মানিক ও কাকের গল্প (২০২৩)।
ছড়াগুলি চমৎকার
ردحذف