কৃষক মাহমুদের একগুচ্ছ নতুন কবিতা:
১) ঘুম এখন খুরের নান্দনিক পরিচ্ছন্নতায়
রমণীর স্তনের মতো সুতীব্র সুন্দর তারাদের হত্যা করতে করতে
পায়চারী করছিল বিপুল অন্ধকার—ওদের চোখে, নখে
আর ছুরি হৃদয়ে লেগেছিল
ভবিষ্যৎগামী রক্ত—
তারপর
সম্মিলিত বজ্রের বৃক্ষরা বুক পেতে দিলো
আর সমস্বরে উচ্চারণ
করলো—এদেশ আমাদের,
এ মৃত্যু আমাদের—এ কুমকুম সকাল আমার সন্তানদের,
অত:পর
এলো না—এলো না কি?
এই নাবালক লাউ ঢগাও হতে
পারে সমুদ্র হত্যার আসামী!
আমি নাপিতের দোকানে যাই চুল কাটানোর অছিলা করে
যদি সেখানে সুখের রাজনীতি না থাকে! রোদের বীর্য
গায়ে মেখে ঘুমাবো কোলবালিশের ছায়ায়...!
হায়...
রাজনীতি এখন
রাজমিস্ত্রীদের হাতে
নাপিতের দোকানে, বাজছে
যেন কাইচে আনন্দে আর
খুরের নান্দনিক পরিচ্ছন্নতায়।
২০.৯.২৪
২) ইয়াসমিন
প্রায়
রাতেই ইয়াসমিন আসে
হারানো
যৌবনের মতো বার বার ফিরে আসে,
কাল
রাতেও এসেছিল—আমাকে নিতে আসে কেন ও;
ইয়াসমিন
তো এখন খোদার জান্নাত ও জাহান্নামের
মধ্যবর্তী কোনো এক মরু পাহাড়ের খেজুর বাগানের পাশে
বসে থাকে—বন ভরা সবুজ পাতার মতো ওর
মাথা ভরা চুল, সাপের লেজের মতো এঁকেবেঁকে যেত—
আকাশের পরাণ কাঁপানো হাসি। যেন আমায় ডাকে মাঝ রাতে
যেভাবে পাহাড় ও আকাশ ডাকে সঙ্গমে আলিঙ্গনের আমোদে...
পৃথিবী ভুলে যাওয়া হাসি রঙের প্রজাপতির মতো মৃত্যুর ডানা তুলে
চলে আসব ইয়াসমিন—তোর হৃদয় ডিঙির পাল তোলা মাছ ঠোঁটে—কতো দূর—
এই হৃদয় হারা হৃদয় থেকে, সাত’শ কোটি দূর মাইল কি এ হৃদয়পুর?
তুই
ছুটে এসেও দূরে থাকিস
ছুঁয়ে দিতে পারিস না একদিন? তুই ছুঁয়ে দিলেই হয়তো
আমার দেহ মুক্ত আত্মা তোর সঙ্গি হতে পারবে—এক সাথে
আমরা ঈশ্বরের থাকার ঘরের দরজা ছুঁয়ে আসবো চোখের হাত দিয়ে।
তারপর কোনো এক সমুদ্র প্রজাপতি হবো দুজন—খোদার চোখের সামনে
সরাব পান করে আমরা বিয়াল্লিশ বছর সঙ্গমরত থাকবো।
আমাদের এই দেহ ও বিদেহর স্বপ্নচারী আধোচেতনের খেলা—স্মৃতির নোনা জলে
হৃদয়ের ঠোঁট ভেঁজানো খেয়ালীপনা—একদিন মুছে যাবে ঠিক কবর-তলা
২৯.৯.২৪
৩) একাত্তরের কঙ্কাল
রাতের শাসন আমল
তুলে নিয়ে যায় স্তন ও
আলো
টুকরো টুকরো করে তারার
ফসিল
পড়ে থাকে দীর্ঘশ্বাসের
কৌটো
এবং কৌটোর মাঝে লুকানো
ছিল—
উল্কা পতন
ঝলসানো কান্না
আছড়ে পড়া আর্তনাদ
অবরুদ্ধ নি:শ্বাস
সেই রাতের চোখ জুড়ে
গণ-কবর
কবর ও মৃতদের চিৎকার
দলে দলে উঠে এলো
একাত্তরের কঙ্কাল
এ-যাবৎকালের শূণ্য ও
নিস্ফলা দলবল
তারপর....
কথারা কথা হতে বাকী
পথ।
২৭.৯.২৩
৪) হাওয়া খুনিদের সংকলন
পায়ের শব্দে গাছের আত্মা কেঁপে ওঠে, আড়াল করে
নেই পাতায় দৃষ্টি-ঘোর—মানুষ শব্দ সংকল
সংরক্ষণ করো,
তার কাছে যেওনা....
গাছেরা মানুষ খেয়ে
ফেলে
মানুষ গাছেদের খেয়ে
ফেলে
দৃশ্যে—অদৃশ্যে....
ফুলের নরম ত্বকদৃশ্যের
নি:শ্বাসের বাতাবরণে গিয়ে বসি
আমি ফুল হয়ে পথে ও প্রান্তরে এসে দেখি—মন খুনি, দেহ খুনি,
আত্মার মতো হাওয়া খুনিদের—খুনিতে খুনি মিলে মসজিদে যায়, মন্দিরে যায়,
দেখো এখানে শিল্প খুন
হয়ে পড়ে আছি
পাহারায় নদী খেকো
মৌ-চাক।
২৭.৯.২৪
৫) বাষট্টি বছর পরে
.
নারীর সংস্পর্শে গেলেই
মাথা পাতলা হয়ে যায়—আলোর
সংস্পর্শে আঁধার—মায়ের
সংস্পর্শে সন্তান। মাছির চোখের মতো চোখ করে চেয়ে থাকি মানুষের অদৃশ্য মাথার ছায়ার
ছাপানো শব্দের দিকে। কতোক’টা ক্ষুধার্ত ভেড়ার মতো—সাপের লেজে নখ লাগালে মাথায় ফণা ওঠে—মানুষ অথবা গরুর লেজেও। সাপের ফণার চেয়ে হাতের ফণা ধির ও ধারালো—প্রবল ভাবে হারানোরও। নুনের স্বাদ বুঝতে গিয়ে—নুন হারানো নদীও নৌকাকে নীরব ঘাতকের মতো দোষারোপ
করে গেছে বাষট্টি বছর—নির্বাক
চরের মতো পড়ে থাকি—বার
বার সেই নদী’ই বুক ভেঙে যায়—তবুও
চেয়ে থাকি আর মানুষের সুবিধার ছায়ায়—তাদের পায়ে পায়ে জীবনের মায়া—বাসরের জরির মতো রঙিন, নতুন বেঁচে থাকার দেয়াল...
আমি তো আমার ভেতরে
হারায়ে’ই হেরে যাই—তোমার
ভেতর হারালে আমার অবয়ব অস্পষ্ট হয়ে যায়, যেমন তাকে চিনিই না বা কোথাও দেখেছি
আমার মতো—নিস্ফলা মাঠ, নদী, কাঁকরোল ডোগা, কিছু কিছু
রাজনীতি এরকম। চুলের তেলের রাজনীতিও যদি বুঝতাম তাহলে গাড়ি, বাড়ি, জেট প্লেনে না—সয়ং রানির মাথায় চড়ে থাকতাম—পাক, পেয়াদা, গার্ড, বডিগার্ড, চোখে চোখে রাখতো
পাশের দেশের রাজ অথবা তার ছেলেও—রমণীর
মাথার তেল।
শেষ বয়সে একজোড়া একটা
হাত দিও খোদা—যার একজোড়া একটা চোখ থাকবে—থাকবে নুনের ক্ষমতা—লালের ক্ষমতা, ইশারা অথবা ফোন কলের ভালোবাসা।
দিও একটা
১০.১২.২৩
৬) ইশারা বিদ্ধ সত্য
রাতের পরনে চাঁদের
তোয়ালে
সঙ্গবদ্ধ হাওয়া—
সূর্যকে শ্মশান করে
কাচের গ্লাসে করে রূপক বনসাই...
বীজের ভেতরেই বৃক্ষের
পরিচয়।
ইশারা বিদ্ধ সত্য সকাল
অন্ধ আয়নায় ভেঙে
পড়ছে
চোখের গুড়ো।
২৫.৯.২৪
৭) ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে
ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে—যে মাটিতে স্মৃতির কঙ্কাল—ফুল মুখে হাসে। দেয়ালে পড়ে নড়া পাতার নরম চঞ্চল
দোল। কলপাড়-নদী যেখানে প্রথম দুধে ধোয়া যৌবন স্নানের আগায় সেজেছিল জোসনার হাসির
মতো কত রাত… এ-সব কিছুই, ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে—জানা কোনো অজানা আলোতে। যখন বাধ্য হয় জীবন জলকে জালিম ভাবতে। পুরনো
টিনের চালে দুপুরের বৃষ্টি আঁকে স্মৃতির পেইন্টিং …
ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে
স্বজনের চোখ, মায়ার আঁচল আর আরতির কাঁন্না। নরম কাদায় পুতে রাখা স্বপ্নের ফুরাত।
নাছরিনের ভার্জিন ফুলে যৌবন বৃক্ষের প্রথম কষ—জেসমিনের সাথে জলের অতলে আলো আধারের বীর্যরোপন কথা। ছেড়ে যেতে
ইচ্ছে করে এ-সব, কেননা মানুষের পক্ষে সব সম্ভব—তবে স্মৃতির দঁড়িতে তাকে বাঁধতেই হয় জীবনের ক্লান্তি। যদি কোনো দিন
ফিরে আসি—সেদিন তিন মুঠ মাটি দিও দেহের কবরে। তোমার দেয়া
দ’চোখ দেখবে না তোমার মুখ—তাতেই
নাকি তোমার সুখ—হ্যাঁ, তোমার সুখের জন্য মা, আমি কিনে নিয়েছি
একটা জীবনের দুঃসহ দুঃখ। বেশ কিছু দিন হলো, দেহ ছেড়েছি তাই শরীরের নাম লাশ—মুর্দার যতো দ্রুত সম্ভব কবর দিতে হবে।
সব ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে—তবু কোথায় যেন মৃত্যুর মতো এক একটি দেহ গোপনে না
না বলে।
৮) মর্গের পথে
ঘুমের পিলে ঘুম নামাই ধানের আড়তে
ফিলিংস পেতে মাঝে মাঝে স্পিরিট মিক্সড করি,
এভাবেই রুচিহীন চোখে ঘুমখাদ্যের রুচি
ডেভেলপ করাই—তারপর কতো রাত দেখে গেল
কালো বিড়ালের চোখ—
সেদিন ছিল ইমাজিন রেইন
নাইট।
স্লিপিং পিল সেবনের সাড়ে চার ঘন্টা পরও ঘুম নিখোঁজ।
ঘর থেকে বের হয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে—রাত কতোটা
যৌবনধারী হলো তার খেয়াল চিবোই।
ধাঁধি ধরা চোখ বেয়ে নেমে এলো রক্ত—অদ্ভুদ ছিল সে রক্তের রঙ ও গুণ ।
শরীরের যে অংশে লাগছে—আঁধার গহ্বর হয়ে যাচ্ছে।
শরীর জুড়ে অসংখ্য গর্ত—সেখান থেকেও ঝরছে মাটিতে—
মাটিরও বুক ফুড়ে চলে যাচ্ছে অলৌকিক অন্ধকার গহ্বর।
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে মাঠের মধ্যে চিৎ শুয়ে—হে খোদা—প্রার্থনা
আমার—বাঁচতে চাইলে, বাঁচাও।
চলে গেল অতলে—
যখন ঘুম ভাঙলো—আমাকে ঘিরে শতেক মানুষ,
হ্যাঁ—ইনি এডিক্টেড ছিলেন, পান করতেন
এবং সেবনে—নূর দেখলো দূরে—মর্গের পথে ও ভেতরে
কিছু মরা ও মানুষ বলাবলি! করছে…।
২০. ৯.২১
০৯.চাঁদের আলোর মতো দীর্ঘকথার
গুড়রঙ গায়ে তার—তারারঙ হাওয়া
হাওয়া রে…
পাখি রে—হাওয়া রে—গায়েব হয়ে
যেতে দেখেছি মাটির
দুধের দিকে
যেখানে—সেখানে কতো কথা মিলে যায়
পায়ের ছাপের মতো—
তাকেও তারার মতো চিনি
যে চাঁদের আলোর মতো
দীর্ঘকথার।
১০.৯.২২