শ্যামসুন্দর দেবনাথের একগুচ্ছ কবিতা

 

শ্যামসুন্দর দেবনাথের একগুচ্ছ কবিতা

ম্যাজিক রিয়েলিজম

 

শ্রাবণের ধারায় তলিয়ে যাচ্ছি

কোথায় যাই?

মেঘের ওপরই চড়ে বসি

স্বল্পায়ু মেঘ পাহাড়ে নিঃশেষ

আশ্রয় হলো পাহাড় চূড়ায়

নিশ্চিন্ত উঁচু তবু টেকা হলো দায়

ইঁদুর চষায় পাহাড় কাত মুনিরা শঙ্কিত।

 

জোছনার রশ্মি বেয়ে চাঁদে উঠি

স্বর্গ ধরার আশায় বসত গড়ি।

এখানে পরি-ভূমি-পদ লোভে দেবতাদেরও কাড়াকাড়ি

ছল-চাতুরি-মুখোশে বড়ো বিরক্তি জাগে 

তাই ইন্টারনেটে ঝাঁপ দিয়ে এবার মঙ্গলে 

মহাজাগতিক গর্জন আর ‘পরা’দের ধ্বংসনেশা

অবশেষে হৃদয়ের ডাক শুনি

শাওন ধারায়ই ডুবে থাকি।

 

দৈববাণী

 

দেব দেব দেব তা

দেব তো বলছি দেব তা

ব্যাকুল হচ্ছ কেন দেব তা

একটু অপেক্ষা করো দেব তো

জানোই তো সবাইকেই তো দিতে হয় 

আমি তো সকলেরই দেবতা

আর একটু ধৈর্য ধরো, দেব তা

আহা বিরক্ত করো না তো

বিশ্বাস রাখো ভক্তি রাখো

পাবে নিশ্চয়ই পাবে যা চাও

আমিই দেব, আমি নয়তো কে দেবে

পাবে পাবে, পাবে তো বলেছি

জানোই তো আমি পেলে তো দেব

আমি তো তোমাদের জন্যই দেবতা

চাওয়ার সাথে সাথেই প্রাপ্তি

সে তো ক্ষণিকের তৃপ্তি

কাজ করে যাও, ফল চেও না

এক চিত্তে এক মনে

কাজ করো, আমার নাম জপো

পাবে পাবে কর্ম অনুযায়ী পাবে

একধ্যানে একমনে

গুণকীর্তন করো দেবতার

না পাওয়া অবধি

পূজা করো

চালিয়ে যাও সেবাধর্ম;

দেব দেব দেব আমি দেবতা দেব তা।

 

মহাশূন্যে কবিতা ওড়াই

 

সুতোছেঁড়া ঘুড়ির পিঠে কবিতা ওড়াই 

হাওয়ার তালে ছেঁড়া মেঘে ছন্দ ছড়াই

আকাশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে হিমালয়ের মাথায় 

কবিতার ক্যাঁচকেঁচানি ঢুস খেয়ে থেমে যায়

প্রতিধ্বনির ছিটকানো টুকরো কানে ফিরে 

ইথার তরঙ্গে নাচে আমার হৃদয় ঘিরে

 

লেজহীন ঘুড়ি লাটাই ছেঁড়া কবিতা

মুক্ত বিভাজনে বেড়ায় চাঁদ-তারার শূন্যে 

মহাশূন্যে পদধূলি ফেলে কবিতিকা

হৃদয়ছেঁড়া প্রেমের এক কণা পুণ্যে

গেঁথে দিলেম আকুতিগোপন কথা

মাটির প্রেম ফুলের হাসি শূন্যতার ব্যথা

আঁধার রাতের সম্বল জোনাকি তারকায়

মাটির প্রেম ফুলের হাসি শূন্যতার ব্যথা

রাখিনি চেপে হৃদয়ের জামধরা দরজায়।

 

একদিন ফিরবে বেহুলার স্বামী

 

বহু প্রতীক্ষার বাসর

বিরহে কালরাত কাতর গৃহবধূ

মায়ের বুকচেরা অপত্য কাড়া রাত

আঁধার ঘের সূর্য না ওঠা ভোর

শীত-গ্রীষ্ম না-মানা ওসে ভেজা চোখ 

মরণের কান্নায়ও সূর্য ওঠে মেঘ কাটে 

মাতৃভূমির মায়াচৌম্বক আমৃত্যু ছায়ামূর্তি 

স্মরণে শয়নে-স্বপনে হৃদয়ে কাঁটা বিধায় 

তাজা একটা জীবন নিয়ে চির নির্বাসন

এ কোন ঋতি! বিবেকের রীতিতে তীরক্ষেপ।

 

প্রকৃতির নিত্য নিয়মভাঙা নির্দয় মানুষ 

শাসন-শোষণের যাঁতায় পিষে মাতৃছায়া 

ভাগাভাগির বিরহ আমৃত্যু জ্বালায় তুষানলে

লখিন্দরের জীবন গিলে নেয় কালনাগিনী 

প্রাণের আকুতিতে বেহুলারাই মিলাবে দম্পতি।

 

নিষ্ঠুর সুখ

 

সৌরভ ছড়ানো গৌরবের লাল গোলাপ 

তৃণমূলের বুকচাপা তীব্র ক্ষুধার প্রলাপ 

আকাশ মাটি কাঁপানো চেতনার আভাস

শিকড় থেকে উঠে পাপড়ি ফোটায় অভিলাষ

মৃদু হাওয়ায় লাখো ফুলদল দোলায়

আপনাকে জাগায় স্বপনের ভেলায়

তরঙ্গ উচ্ছ্বাসে টেনে নৌকায় ওঠায় 

সহমাঝির হাতে দাঁড় রঙিন পাল খাটায় 

এত ফুলের মাঝে গোলাপটি লুকায়। 

হাসিমাখা লাখো মুখ ধুলায় লুটায়

ঝরে যাওয়া নির্মমতা বাতাস কাঁদায় 

দেবালয়ে শ্রদ্ধার্য্যে মালার ফুল শুকায়।

 

মানুষের জন্য মানুষ কাঁদে জীবনভর 

চোখে জল শূন্যতায় বুক করে চড়চড় 

প্রাণের মানুষ ওড়ায় ফানুস মুক্ত আকাশ 

তীব্র তাপে ফোটে তবু মানুষের মাঝে বসবাস

কায়াহীন জীবন ছায়ার মতো নড়ে নড়ে 

স্মৃতিঘেরা সীমানায় বেড়া চলে নীলিমা ধরে

আমরা ছুটে যাই মায়াবন হরিণীর বেশে 

পাই না তারে তবু খুঁজে বেড়াই দেশে বিদেশে।

 

ধনীর আশ্বাসে গরিবের প্রত্যয় ধুধুর পর ধুধু

দৌড়ায়ে বিফল প্রাপ্তির মরীচিকা শুধু 

মরণে কাঁদায় জন্মে হাসায় শিশুর মুখ 

হারানোর বিরহে স্মৃতি জাগায় নিষ্ঠুর সুখ।

 

আমার মাঝে আমি

 

আমি বস্তুমাঝে আমাকেই ধেয়ান করি 

আপন হৃদয়ে আপনাকেই খুঁজে মরি। 

শক্তির উপর ভর রেখে নিজেকেই ধরি 

অন্যকে নমিয়া আমাকেই নমস্কার করি।

 

আমি গান-কীর্তনে যখন চোখ ভাসাই 

ভাবসিক্ত শ্রোতামাঝে নিজেকেই কাঁদাই। 

আমার মাঝে যখন আমি না থাকি

‘হে প্রভু’ বলে আমি আমাকেই ডাকি। 

আমি আষ্টেপৃষ্ঠে আমাকেই ভালোবাসি

চক্রবাল প্রণামেও আমাতেই ফিরে আসি।

 

প্রেমীর হৃদয়মাঝে আমি আমাকেই খুঁজি 

প্রতিহিংসায় আমি আমার সাথেই যুঝি।

তীব্র লিপ্সা খসায় ক্রোধ যখন চটে

অন্যে নয়, নিজের মাঝেই হতাহত ঘটে।

 

আমার মাঝে আমিই নিত্য সৃষ্টি খেলি 

নিদ্রাস্বপ্নে নিজের মাঝে নিজেকে লুকায়ে ফেলি।

জন্মে আমারই দুখণ্ড সত্তার পুনর্মিলন 

মৃত্যুতে আমার আমি আমাতেই বিলোপন।

 

সূর্যরথ

 

কৃষ্ণপক্ষের রজনি জোনাক জাগার বিশ্ব 

হাঁটাপথে নিকষ আঁধার পিয়ে বাঁচে নিঃস্ব 

চাঁদ অদৃশ্য চন্দ্রবিন্দু শব্দ খুঁজে বেড়ায় 

গরিবের ঘর পোড়ে ধনীর অগ্নিনেশায়।

 

অর্ধাঙ্গিনীহারা হৃদয় মরুভূমি সাহারা 

চিতায় পোড়ে প্রেম ছাইয়ে বিরহের ধারা 

আজও বয়ে চলে নালখাল নদী সাগরে

ভেলাহীন অকূলপাথার ভাঙাঢেউ ধরে

ভেসে চলে সূর্য ওঠার লাল দিগন্ত পানে 

শোষণ বাণিজ্যতরী নিষ্ঠুর আঘাত হানে 

ঝোঁক বুঝে কানে দেয় লোভেপড়া মায়ামন্ত্র

পরের ভিটে গেলার ফন্দি, মুখে গণতন্ত্র।

 

বেড়ায় খায় কৃষকের রক্তঝরা ফসল 

অসহায় ক্ষণ কাঁদায় ভণ্ড মুখোশধারী দল 

অশ্রুমোছা আদুরে আঁচল ওড়ায় আড়ালে 

কেউ ডোবে গভীর লোভে বসে ঝোঁপডালে।

 

সব বুঝেও অবুঝের চাওয়া ফ্যালফ্যাল 

তৃষ্ণার্ত চোখ শুকনো মাথায় পড়ে না তেল 

তবু জীবন আছে জীবিকায় টান সাধ্য কম 

মানুষ আছে আজও তাই দেহে জাগে দম 

বিত্তবানের পিয়াসি চিত্ত রক্তচোষা জোঁক 

চিত্তবানের শক্তহাত নিত্য শক্তি আলোক 

জোনাকির আলোয় ভরসা পায়েহাঁটা পথ

সূর্যরথ ওড়াবে একদিন আঁধার ভাঙার শপথ।

 

কুড়াই ঝরা ফুল

 

কালবেলায় উত্থান তোমার সত্য-সুন্দর উৎসর্গে

‘নিকুঞ্জ পথে’ অবরোহণ ঝোপ-জঙ্গলে ছিঁড়ে ছিঁড়ে

পঙ্কিল বাধা কাঁটার আঁচড় যাতনা দেয়া বিসর্গে

আপন দারিদ্র্য বোধে শোষণ পীড়ন বঞ্চনা ঘিরে।

অসহায় মানুষের বেদনাবিধুর হৃদয়ের কথা

ঝরণাধারায় গেঁথে গেয়ে গেলে তুমি অবিরাম।

বাংলা-ভারত ছেপে জগতের দুঃখে তোমারই ব্যথা

অন্যায় অবিচারে প্রতিঘাত বিদ্রোহী কবি এক নাম।

 

মহাসাগরের স্রোত উত্তাল তোমার শব্দব্রহ্ম

সফেন তরঙ্গ অভিঘাত তলার মাটি ছুঁয়ে যায়

শিকড়ে জাগা লতাপাতা ঘাস বৃক্ষ-বীরুৎ-গুল্ম

আবদ্ধ পরিসর ছেড়ে মুক্ত আকাশ পানে আগায়।

 

জাতের নামে বজ্জাতি ভণ্ডামি, দুর্নীতিবিরুদ্ধ চেতনা

‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ ভেঙে ফেলার উৎকর্ণ ডাক

বিদ্রোহীর উন্নত শির প্রতিবাদে অদম্য প্রেরণা

কবিতা তোমার জাগরণী গান জীবন জাগানো হাঁক।

অমাবস্যার সূর্য পূর্ণিমার চাঁদ যখন রাহু গিলে

অস্ত্র তোমার রণসঙ্গীত আঁধার ভাঙার দৃপ্ত শপথে

সাম্যের গান বিপ্লবের ডাক নিপীড়িত বাঙালি মিলে

স্বদেশ করে স্বাধীন রক্তস্নাত সশস্ত্র সংগ্রাম পথে।

 

আজো কৃষ্ণজোছনা ছানি মানব চোখে কুহকী ভয়

ঘুণধরা সমাজে জুজুডাইনি প্রতিহিংসা গোঁড়ামি

জঠরজ্বালা বাঁচার আর্তনাদ হতাশার আশ্রয়

পুরনো জঞ্জাল নতুন আগাছা সরানো মন্ত্রই তুমি।

 

রণে বনে কোণে ধর্মে বিপ্লবে বাজে তোমারই গান

গদ্যে পদ্যে উপন্যাসে বিচরণ মুক্ত তোমার ডানা

লাখো লাখো চাওয়া পাওয়ার তুমিই অভিধান

অধিকার আদায়ে, প্রেম-বিরহে তুমিই ঠিকানা।

 

খোলস মোলাহেজা

 

হনুমানের খোলস পরে চিড়িয়াখানায় তুমি

একগাছ থেকে আরেক গাছে লাফ দিতেই

পড়ে গেলে বাঘের খাঁচায়

প্রচণ্ড ভয়ে গগনবিদারী চিৎকার তোমার

বাঁচাও, বাঁচাও, আমি মানুষ, আমাকে বাঁচাও।

 

দর্শকের ধিক্কারবেশ হয়েছে, খাক এখন,

মানুষ হনুমান হয়েছ! এতদিন ঠকিয়েছ।

প্রতারক কোথাকার, বাঘেই খাক তোকে।

এখন গণিত সূত্রে দ্যাখো

মানুষ হিসেবে তোমার মূঢ়তা

আর হনুমান হিসেবে ভয়কাতরতা

তোমার ভবিষ্যৎ তো বাঘের পেটে নিশ্চিত।

উল্টো মোচড়ে জীবনের কাঁটা ঘুরে যায় পলকে

সগর্জনে বাঘের গতিবিদ্যুৎতোমাকে নিধন নয়

তার উদ্বেগ, চিড়িয়াখানার ইজ্জত যায় যায়

মুহূর্তের উৎকণ্ঠায় কানের কাছে ফিসফিসে মুখ-

‘এই চুপ কর হতভাগা, আমিও মানুষ

তোকে খাব না’

মৃতবৎ দেহখানি শুঁকে শুঁকে ফিরে গেল বাঘ।

 

জীবন্ত যন্ত্রণায় পাথরজীবন

 

অগ্নিতে আমি বাঁচি, নিঃস্ব হয়েও বাঁচি

অসুখের মধ্যে ধুঁকে বাঁচি হৃদরোগে

প্রচণ্ড বুকের ব্যথায় অসহ্য যন্ত্রণায়

আমি বাঁচি হাজারো কষ্টের মাঝে

অকাল বিপত্নীকতার দুঃখের সাগরে ভেসেও

আমি বাঁচি অপ্রতিরুদ্ধ উত্তাল আহাজারিতে

নিজের শতসৃষ্টিকর্মের ধ্বংসস্তুপে বসে

ভস্মস্তুপে হৃদয়ের জনালার ফাঁকে ফাঁকে

আমি বেঁচে উঠি মানুষের ভালোবাসার ভরে।

 

দেশমাতৃকার অপার অপত্যস্নেহে আমি বাঁচি

দুষ্টের বদমাসির মাঝেও আমি বাঁচি চেতনায়

উৎখাত ষড়যন্ত্রের বাস্তুহারার মর্মবেদনার মাঝে,

জমিলোভীর উৎপাত, অনাচারপদাঘাত করে

আমি বাঁচি ঠকবাজের প্রতারণা গলাটিপে

শিকারকাতর আমি এক জীবন্ত যন্ত্রণা।

 

প্রেমের বজ্রাঘাতে পোড়াদেহে আমি বাঁচি

ভালোবাসার অত্যাচার অপঘাত মাটিতে মিশিয়ে

আমি বাঁচি চোখের জলে ভেলায় চড়ে

ভালো মানুষ অথচ কথা রাখে না এ কষ্ট বয়ে

সফেন ঊর্মি আঘাত ছটফটানি অন্তরে চেপে

আমি বাঁচি পাথরজীবন পাথারবুকে ভেসে।

 

লেখক পরিচিতি: 

শ্যামসুন্দর দেবনাথ। ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ পালং, শরীয়তপুরে জন্মগ্রহণ করেন। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা প্রচারবিমুখ, সদালাপী, ইতিহাস ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতির উপকরণ সংগ্রাহক ও গবেষক এই শুভজন এ যাবৎ অসংখ্য কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, গল্প, চুটকি, রম্যরচনা, গান ও উপন্যাস লিখেছেন।

তিনি শরীয়তপুরে বহু সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি বহু সাহিত্য-সাময়িকী ও সংকলন সম্পাদনা করেছেন। লোকজশিল্পে অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন ‘জাতীয় সাহিত্য পরিষদ শরীয়তপুর’ জেলা শাখা পুরষ্কার ২০১৪। এছাড়াও অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন।

 

তাঁর কবিতা ভাবনার জগৎ আপন সমাজ, কখনো তা সমাজ ছুঁয়ে আন্তর্জাতিক আকাশ স্পর্শ করতে চেয়েছে। বিশেষ করে সমাজের ব্রাত্যজনের দুঃখ-সুখই তাঁর কাব্যিক হৃদয়ভূমিতে তোলপাড় তুলেছে। কখনো-কখনো গদ্যের প্রাচীর টপকে ছন্দের ঝরনায় স্নাত হয়েছে। তাঁর শব্দচয়ন, বর্ণনার রং এবং ভাবনার আদলটা যেন তাঁর নিজস্ব। একবারে নিজের মতো করে বুনেছেন শব্দের মেখলা।

 

 


إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم