বাঙালির গর্ব প্রখ্যাত বিজ্ঞানী গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য
শ্যামসুন্দর
দেবনাথ
গোপাল চন্দ্র
ভট্টাচার্যের জন্ম: ১ আগস্ট ১৮৯৫ খ্রি.। পিতা- লোনসিং গ্রামের দরিদ্র কুলিন
ব্রাহ্মণ পুরোহিত। মাতা- শশীমুখী দেবী, গৃহিণী। পিতামাতার চার (ছেলে) সন্তানের
মধ্যে গোপালচন্দ্র ছিলেন জ্যেষ্ঠ। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে লোনসিং হাইস্কুল থেকে প্রথম
বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। এরপর ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। বিভিন্ন কারণে
পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি লোনসিং হাইস্কুলে ও পণ্ডিতসার হাই স্কুলে শিক্ষকতা
করেন (১৯১৫--১৯১৯)। এই সময় তিনি সাহিত্যের প্রতি ঝুকে পড়েন। জারি গান, পালা গান, লোকসংগীত
রচনা করেন এবং বনে-বাদাড়ে ও ঝোপঝাড়ে ঘুরে ঘুরে কীটপতঙ্গ বিষয়ক প্রভূত অভিজ্ঞতা
অর্জন করেন। বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাসের সহযোগিতায় তিনি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর
সঙ্গ লাভ করেন; ‘বসু বিজ্ঞান মন্দিরে’র সহকারী গবেষকের দায়িত্ব পালন করেন
(১৯১৯--১৯২১)। তিনি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ (বেঙ্গল সায়েন্স কাউন্সিল ১৯৪৮) এর
মুখপাত্র ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন প্রায় ত্রিশোর্ধকাল । তাঁর
প্রকাশিত ষোলটি গ্রন্থের সন্ধান পাওয় যায়:
১.বাংলার মাকড়সা (১৯৮৯)
২. করে দেখো (১ম খণ্ড- ১৯৫৩), (২য় খণ্ড- ১৯৫৬), (৩য় খণ্ড- ১৯৭৭)
৩.বাংলার কীটপতঙ্গ (১৯৭৫)
৪. মনে পড়ে (১৯৭৭)
৫. পশুপাখি কীট-পতঙ্গ (১৯৭৫)
৬. বিজ্ঞানের আকস্মিক আবিষ্কার (১৯৮৪)
৭. বাঙলার গাছপালা (১৯৮৬)
৮. বিজ্ঞান অমনিবাস (১৯৮৭)
৯. আধুনিক বিজ্ঞান (জেনারেল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স কলকাতা)
১০. আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু (১৯৭৬)
১১. জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা খবর (দে’জ পাবলিশিং)
১২. বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান সংবাদ(দে’জ পাবলিশিং)
১৩. মানব কল্যাণে পারমানবিক বিজ্ঞান (দে’জ পাবলিশিং)
১৪.আণবিক বোমা (অনুবাদ গ্রন্থ- শ্রীভূমি পাবলিশিং)
১৫. মহাশূন্যে অভিযান (১৯৫৮)
১৬. জীববিজ্ঞান (পাঠ্যপুস্তক- মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ ও বঙ্গীয়
বিজ্ঞান পরিষদ)
এছাড়াও
তাঁর কমপক্ষে ১০০০ (এক হাজার) টি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কবিতা, ছড়া, জারি
গান, টুকরো স্মৃতিচারণ অগ্রন্ত্রিত রয়ে গেছে। তিনি ‘ভারত কোষ’ গ্রন্থের চারখণ্ডের
অন্যতম সম্পাদক এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিভাষা কমিটির সদস্য হিসেবে পরিভাষা প্রণয়ন
করেছেন। ইংরেজি ভাষায়ও তাঁর গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৮১
সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি (ডক্টর অফ সায়েন্স) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮
সালে আনন্দ পুরস্কার, ১৯৭৪ সালে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ কর্তৃক সত্যেন্দ্রনাথ বসু
স্মৃতি ফলক লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে একুশে সেপ্টেম্বর বসু বিজ্ঞান মন্দিরে নাগরিক
সংবর্ধনা লাভ এবং ১৯৭৫ সালে ‘কীটপতঙ্গ’ শীর্ষক গ্রন্থটির জন্য ‘রবীন্দ্র পুরস্কারে
ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৮সালে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের হীরক জয়ন্তী উপলক্ষ্যে জুবিলি মেডেল
লাভ করেন।
২০০৫
খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে ‘গোপাল চন্দ্র
ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার’ নামে একটি পুরস্কার তাঁর নামে প্রবর্তন করে। সে বছরই
কীটতত্ত্ববিদ দেবাশিস বিশ্বাস গল্পের মাধ্যমে মশার জীববিজ্ঞান ও ম্যালেরিয়া
প্রতিরোধের বর্ণনা করে কয়েকটি বই লেখার জন্য এ পুরস্কারে ভূষিত হন।
বিখ্যাত
এ বিজ্ঞানী ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ৮ এপ্রিল বুধবার রাত ১১ টা ৫ মিনিটে কলকাতার নিজ
ভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর ৮ মাস ৮ দিন।
স্ত্রী লাবণ্যময়ী দেবী একযুগ আগেই মারা গিয়েছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি চার ছেলে, এক
মেয়ে ও জামাই, বহু পৌত্র-পৌত্রী এবং অগণিত ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ী রেখে গিয়েছেন।
বিজ্ঞানী
গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্যের স্মৃতি রক্ষার্থে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘গোপাল
ভট্টাচার্য বিজ্ঞান প্রসার সমিতি’। কলকাতার একটি পার্কের নামও তাঁর নামে রাখা হয়েছে।
জন্মস্থান বাংলাদেশেও ‘গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি সংসদ’ ও ‘গোপাল চন্দ্র
ভট্টাচার্য স্মৃতি উদ্যান- লোনসিং, শরীয়তপুর’ ও ‘বিজ্ঞানী গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য
স্মৃতি পাঠাগার- লোনসিং, শরীয়তপুর’ প্রভৃতি সংগঠন প্রতিভাদীপ্ত এ বিজ্ঞানীর
আলোকিত-অধ্যবসায়ী স্মৃতিকে অম্লান করে নবক্রমিক প্রজন্মের মধ্যে বিজ্ঞান অনুশীলন ও
মুক্তবুদ্ধি চর্চার অঙ্কুরোদগম ঘটাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, লোকজ
গবেষক ও প্রধান সম্পাদক, কীর্তিনাশার কাব্য।