পান্থ মুসাফির এর দুটি অনুগল্প
০১.
ভুলতে পারিনি যে মুখ
মনির স্কুল জীবন
থেকেই খুব প্রত্যুৎপন্নমতি ছিল। লেখাপড়ায় খুব ভালো করতে পারতোনা। কিন্তু ক্লাসে
পড়া না পারলেও উপস্থিত বুদ্ধির কারণে শিক্ষকগণ তাকে শান্তি দেয়ার সুযোগ পেতেন না। কারণ
স্যার পড়া জিজ্ঞেস করে তার পর্যন্ত আসতেই বীরের মতো দাঁড়িয়ে যেত এবং দ্রুততার সাথে
কী যেন পড়েই বসে পড়তো। যা স্যারও ভালো করে বুঝে সাড়তো না। তবে সে খুব সুন্দর গান
গাইতে পারতো। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় গানে তার সামনে প্রথম পুরষ্কার আর নেয় কে।
এছাড়া মজার মজার কৌতুক দিয়ে সবাইকে মাতিয়ে রাখতো। তাই দুষ্টুমির চরম সীমায় পৌঁছলেও
কেউ তার বিরুদ্ধে নালিশ করতো না। এভাবেই ক্লাস পেরিয়ে নাইনে ওঠে গেল সে। বোর্ড
রেজিষ্ট্রেশন হয়ে গেল যথারীতি। সাইজে ছোট হলেও বয়সে তো আর অতো ছোট না। অর্থাৎ মনের
মধ্যে ভালোলাগা-ভালোবাসার অনুভূতি দোলা দিতে শুরু করেছিল। অবশ্য ভালো গান গাওয়ার
কারণে অনেক মেয়ে মনে মনে খুব পছন্দ করতো তাকে। আকার ঈঙ্গিতে এসব বুঝে ওর কাছে
ভালোই লাগতো এবং নিজেকে গর্বিত ভাবতো। ইতোমধ্যে ওর মনেও একজনকে ভালো লাগতে শুরু
করলো। পছন্দের মানুষটির নাম হামিদা আক্তার। কিন্তু হামিদা যে এর আগেই আরেক জনের
মনের জালে বাঁধা পড়ে গেছে তা কি আর ‘ও’ জানতো। হামিদার চুল ছিল নজরকাড়া লম্বা।
বেণী করলে সাপের মতো, খোঁপা করলে ময়ূর পেখমের মতো আবার খুলে রাখলে পিঠ জুড়ে অন্ধকার
বিদিশার নিশার মতো ছেয়ে থাকতো। তাইতো মনিরের অনেক দিনের আশা ছিল পছন্দের মানুষটির
খোঁপায় গুঁজে দিবে বেলি ফুলের মালা।
হামিদাকে এর আগেই প্রেমের অফার দিয়ে কিছুটা মৌন সমর্থন পেয়েছিল দূরম্পর্কের কাজিন জাফর। জাফর খুব ভালো ছাত্র হওয়ায় হামিদা ভবিষ্যৎ স্বপ্ন আঁকতেছিল। কিন্তু সে মনিরকেও অপছন্দ করতো না। একদিন সত্যিই মনির বেলি ফুলের মালা এনে পরিয়ে দিতে চেয়েছিল হামিদার খোঁপায়। জাফর দেখে ফেলায় নিজেকে বাঁচাতে হামিদাও একটু চটে গিয়েছিল। আর সেই সুযোগে জাফর ব্যাপারটিকে তিল থেকে তাল বানিয়ে স্যারদের কাছে নালিশ করে তুলকালাম কাণ্ড ঘটালো। শেষ পর্যন্ত স্কুল কমিটির কানে পৌঁছলে ঘটে গেল বিপত্তি। মনিরকে লাল টিসি দিয়ে বহিষ্কার করা হলো। এতোকিছু ঘটবে হামিদাও ভাবতে পারেনি। অবশ্য জাফর মনে মনে খুশি হয়েছিল। মনির খুব দোষী না হলেও এ অনাকাঙ্খিত ঘটনায় মনিরের মৌলভী বাবা ও পরিবার ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। মনির খুব সাহসী হওয়ায় ভেঙ্গে পড়েনি। এমনকি মনের জেদে সে সবার অজান্তে পায়ে হেঁটে-গাড়িতে চড়ে চট্টগ্রাম দিয়ে মিয়ানমার হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারযোগে মালয়েশিয়া ঢুকে পড়ে। সেই যে গেল একটানা বারো বছর কাটালো সেখানে। এরই মাঝে হামিদার অন্যত্র বিয়ে হয়। কারণ জাফরের সঙ্গে তার সম্পর্ক টিকেনি। অবশ্য হামিদার বিয়েটা হয়েছিল এসএসসি পরীক্ষা দিতে এসে ভাড়া বাসার বাড়ীওয়ালার ছেলের সাথে পারিবারিক সিদ্ধান্তে। যদিও তাদের মধ্যে কিছুটা ভাবের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ বিয়েটিও টিকলো না হামিদার। তাই সে লজ্জা ও মনোকষ্টে সবার অগোচরে ঢাকায় কাজ খুঁজতে গিয়ে পাচারকারীচক্রের পাল্লায় পড়ে। পাচারকারীরা তাকে বিদেশ পাঠানোর কথা বলে মালয়েশিয়ায় নিষিদ্ধপল্লীতে বিক্রি করে দেয়। মনির মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে যাওয়ায় বেশ কিছুদিন তাকে কষ্টে কাটাতে হয়েছিল। এর পরে আর্থিকভাবে ভালো থাকলেও মানসিকভাবে তেমন ভালো ছিল না। কারণ এতোটি বছর পরিবারের কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না। তাছাড়া সেই প্রিয় মুখটি থেকে... থেকে... উকি দিতো মনের আয়নায়। তাইতো মাঝে মধ্যে মনের কষ্ট ভুলতে সে নিষিদ্ধ জায়গায় যাওয়া-আসা করতো। কিন্তু একদিন সে যে ঘরটিতে ঢুকলো সেখানেই অনাকাঙ্খিত ঠিকানা হয়েছিল হামিদার। সেই স্কুলজীবনের প্রিয় চেনা মুখটি এখানে। সে মানতেই পারছিল না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবছে এ আমি কী দেখছি? নাকি নেশারঘোরে আবোল-তাবোল ভাসছে চোখের সামনে। ঘোরের মধ্যে থাকায় সে নর্তকী বেশের হামিদাকে বলছে—‘এই তুমি কে? আমার গায়ে একটি চিমটি কাটোতো...।’
হামিদা অশ্রুসিক্ত হয়ে প্রশ্ন করে—‘আপনি কি এখানে প্রায়ই আসেন?’
০২. বরষা এসেছিল আষাঢ়ের রাতে
মানুষ স্বপ্ন
দেখে। স্বপ্নের মধ্যদিয়ে মানুষ বড় হতে থাকে। মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বেশি বড়।
স্বপ্ন কেউ ঘুমিয়েও দেখে আবার কেউ স্বপ্ন দেখার তাগিদে ঘুমাতেও পারে না। তাইতো
ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি, দার্শনিক ও বিজ্ঞানী এপিজে আবুল কালাম (আবুল পাকির
জয়নুল আবেদীন) বলেছেন, ‘স্বপ্ন ওটা নয় যেটা মানুষ ঘুমিয়ে দেখে, প্রকৃত স্বপ্ন সেটা
যেটা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না’। অর্থাৎ যে অসম্ভবকে সম্ভব করার তাড়নায় কল্পনায় ছক আঁকতে
আঁকতে মানুষ ঘুমাতে পারে না—তাই হলো স্বপ্ন। এ
সূত্র ধরেইতো মানুষ অজানাকে জানার জন্য কৌতুহলী হয়, হারানোকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল
হয়। এটা মানুষের জন্মগত সহজাত প্রবৃত্তি। মহান সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেক জীবের ভিতরে
প্রেম, আত্মা, ভালোবাসা ও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আর
মানুষতো সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। তাই সব জীবের মধ্যে প্রেম থাকলেও একমাত্র মানুষের
মধ্যে প্রেমাত্মার সাথে বিবেক ও মনুষ্যত্ববোধ আছে, অন্য প্রাণীর মধ্যে যা নেই।
রতন ও বরষা পুরোপুরি অচেনা অজানা দু’জন
মানুষ। ভিন্ন পরিবার পরিবেশ, ভিন্ন এলাকা ও মনমানসিকতার দু’জন ওরা। তবে ছোটবেলা
থেকেই তারা দু’জন পিতামাতার খুব অনুগত আদর্শবান বিনয়ী সন্তান। পড়ালেখার প্রতি
প্রবল আগ্রহ। কখনো পড়ার টেবিলে বসার জন্য তাগাদা দিতে হয় না। পড়ালেখার পাশাপাশি
পিতামাতাকে সাংসারিক কাজে যথাসম্ভব সহযোগিতা করে থাকে। এসব কথা শুনে এবং স্কুলে
আদব কায়দা দেখে তার শিক্ষকগণও সন্তুষ্ট। সুন্দর চরিত্র এবং লেখাপড়ায় বরাবরই
প্রত্যেক ক্লাসে তারা ভালো ফলাফল করে আসছে। এ জন্য শিক্ষকগণও তাদেরকে বিশেষভাবে
যত্ন করে ভালোবাসে। ভালোবাসবে না কেন? শৈশবকাল থেকেই তাদের মধ্যে পিতামাতা,
পরিবার, শিক্ষাগুরু, সমাজ, দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করার প্রবণতা দেখা যায়। কারও
স্বপ্ন ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবে, কেউ প্রশাসক হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করবে।
এদের দ্বারা কোনোদিন সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিন্দু পরিমাণ ক্ষতি হয়নি।
উপরন্তু, বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ও আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখতো। বিভিন্ন প্রকার গাছ
লাগিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতো দল বেঁধে। তারা বুঝতে শিখেছিল
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি আসবাবপত্র বা সরঞ্জাম নষ্ট করা মানে জাতীয় সম্পদ নষ্ট
করা। যার ক্ষতিপূরণ পরোক্ষভাবে কর, খাজনা ও ট্যাক্স পরিশোধের মাধ্যমে তাদের
পরিবারের ওপর পড়ে!
বিশ বছর আগের কথা। এসএসসি পরীক্ষা
দিতে এসে পরিচয় ঘটে বরষার সাথে রতনের। এর আগে কেউ কাউকে চিনতো না জানতো না। একই
কেন্দ্রে একই কক্ষে পাশাপাশি আসন বণ্টিত হওয়ায় তাদের মধ্যে পরিচয় হয়। অবশ্য দু’জনই
ছিল গ্রামের দুটি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পড়াশুনায় দু’জনই ছিল
মেধা তালিকায় দুটি স্কুলের প্রথম স্থানধারী। আর এ কথাটি তারা জানতে পারলো পরীক্ষার
কক্ষে দায়িত্বরত পরিদর্শক স্যারের কাছ থেকে। অবশ্য দু’জনের পরীক্ষার খাতায় লেখার
গতি দেখে পর্যেবক্ষক স্যার জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন তাদের স্কুল জীবনের কৃতিত্বের
কথা।
লেখার ফুরসতে মাঝে মধ্যে তারা মুখ
তুলে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকায় পরস্পরের দিকে। আবার চোখাচোখি হলে যথারীতি চলতে থাকে
প্রশ্নোত্তর লেখার কাজ। তবে মনের ভিতর কৌতুহল বাড়তে থাকে পরীক্ষা শেষে গভীরভাবে
জানাশুনা হবে একে অন্যকে। হয়তো বিষয়ভিত্তিক নোট-সাজেশনও কিছুটা পাওয়া যেতে পারে।
পরীক্ষা শেষে যথারীতি তারা দেখা করে পরীক্ষায় প্রশ্নোত্তর কেমন লিখেছে এসব বিষয়ে
আলাপ করে, পরের বিষয়ের সাজেশন ও নোট সংগ্রহ করে। তাই এখনকার পরীক্ষাগুলো আরও ভালো
হচ্ছে। এই উছিলায় যোগাযোগটা রক্ষা করা হচ্ছে। সেই থেকেই এক অন্যরকম ভিন্ন অনুভূতি
প্রকাশ, পরিচয়। দিনে দিনে ভালো লাগা থেকে ভাবের আদানপ্রদান চলতে থাকে তাদের।
ইদানীং মনের টানে পরীক্ষা শুরুর
একঘণ্টা আগেই দু’জন চলে আসে পরীক্ষারকেন্দ্রে। এমনকি বরষা দু’একদিন একা একাই
পরীক্ষার হলে চলে আসতেছে। অথচ এর আগে সে বাবা-মা বা অন্য কোনো আত্মীয়ের সহযোগিতা
ছাড়া পরীক্ষা কেন্দ্রে আসতে সাহস পেত না। আসতো পরীক্ষা শুরুর ২০ থেকে ৩০ মিনিট
আগে। কিন্তু হঠাৎ করে মেয়ের আচরণে কিছুটা পরিবর্তন ও সাহসের সীমা দেখে বাবা- মা
অবাক! আবার ভাবছেন হতে পারে পরীক্ষা দিতে আসতে যেতে মেয়ের সাহস সঞ্চয় হয়েছে।
একে একে রুটিন থেকে পরীক্ষার বিষয় কমে
আসছে। একদিন পরীক্ষা শেষে বরষাকে নিতে আসে তার মামাতো ভাই রিফাত। এসে রিফাত দেখতে
পেলো বরষা ছুটির ঘণ্টা পড়ার আগেই হল থেকে বের হয়ে একটি ছেলের সাথে রিক্সায় চড়ে
এগিয়ে যাচ্ছে। রিফাত ডাকলেও সে খেয়াল করেনি।
গল্পে আড্ডায় কিছুটা সময় কাটিয়ে বরষা
আজ একাই বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু বরষাকে সাথে আনতে না পেরে হিংসায় রিফাত বিকেল বেলা
বরষাদের বাড়ি গিয়ে নেতিবাচক কথা বলে বরষার বাবা-মায়ের মনে সন্দেহ ও ক্ষোভের সৃষ্টি
করিয়ে দিয়েছে। গ্রামের সহজ-সরল বাব-মা রিফাতের কথায় বরষার ওপর কিছুটা অসন্তুষ্ট
হয়ে শাসন আরোপ করতে থাকে। মামাতো ভাই রিফাত এ ঘটনার নায়ক হওয়ায় বরষা এখন আর
রিফাতকে সহ্য করতে পারছে না। এসএসসি পরীক্ষা যথারীতি শেষ হলো। এবার রেজাল্টের
অপেক্ষা। তবে বরষা ও রিফাত দু’জন এখন আর দেখা সাক্ষাত বা যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছে
না। মাঝে মধ্যে চিঠি পত্র আদানপ্রদানের মাধ্যমে কুশলাদি বিনিময় চলছে। এভাবে সময়
গড়িয়ে একদিন রেজাল্ট প্রকাশিত হলো। দু’জনই লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে পাস করে।
শুরু হয় কলেজে ভর্তির চিন্তা ও যুদ্ধ।
জেলা শহরের সরকারি কলেজে দু’জনেই ভর্তির সুযোগ পায় এখন তারা একই কলেজের
শিক্ষার্থী। এ যেন শাপেবর, মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! তবে কথা হলো গ্রাম থেকে ৪-৫ কিঃ
মিঃ দূরে হেঁটে বা রিক্সা, ভ্যানে এসে কারোর পক্ষেই নিয়মিত কলেজ ক্লাস করা সম্ভব
হয়ে ওঠে না। জেলা শহরে রতনের আত্মীয় থাকায় সে আত্মীয়ের বাসায় এসে ওঠে। কিন্তু
বরষার কী গতি হবে? বরষার বাবা একটি সরকারি অফিসের পিয়ন। মেয়ের পড়াশুনার কথা চিন্তা
করে সে থানা অফিস থেকে উৎকোচ দিয়ে জেলা অফিসে পোষ্টিং নিলো। তাছাড়া এখানে বাড়তি
রোজগারের সুযোগটাও একটু বেশি। তাই সে ফ্যামিলিসহ শহরে থাকার জন্য বাসা ভাড়া নিল।
কিন্তু এতে বরষা ও রতনের বিধি ডান!
কাকতালীয়ভাবে দু’পরিবারের ভাড়া বাসাও একই মহল্লায় জুটে গেল। এ কথা কারো গার্ডিয়ান
জানতো না। তাই ওরা এবার সময়ে অসময়ে দেখা সাক্ষাত করে যাচ্ছে। তবে তারা একে অন্যের
বাসায় কেউ যাচ্ছে না, দেখা সাক্ষাত করছে না। কিছুদিন কাটতে না-কাটতেই হঠাৎ বিধি
বাম! মামাতো ভাই রিফাতের প্রতিহিংসায় রতন ও বরষার পরিবার এ ঘটনা জেনে গেলো। ফলে
তাদের যোগাযোগে বাঁধ সাধলো দুই পরিবার। কিন্তু শাস্ত্রের কথা, ‘প্রেমের মরা জলে
ডুবে না।’
এমনিভাবে সময়ের চাকা গড়িয়ে একসময় চলে
এলো এইচএসসি পরীক্ষা। সময়টা আষাঢ় মাস, বর্ষাকাল। অফিসের জরুরী কাজে বরষার বাবা
ঢাকায় যায় দু’একদিনের জন্য। এমনি এক ঝাড় বৃষ্টির রাত্রি কাটছিল। ফাইনাল পরীক্ষা
কাছাকাছি হওয়ায় বরষা রাত জেগে পড়তেছিলো। রাত ২টা। হঠাৎ করে বরষার মা প্রচণ্ড
অসুস্থ হয়ে পড়লো। বরষা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে কাঁদছে। বাবা বাড়ি নেই। বাসায় আর কোনো
পুরুষ মানুষও নেই। এতো রাতে সে একটা মেয়ে হয়ে কী করে মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে? এ
রাতে যানবাহনইবা পাবে কোথায়? ওদিকে অসুস্থতার যন্ত্রণা সইতে না পেরে মা বরষাকে
বললেন, ‘রতনকে একটু ডেকে নিয়ে ডাক্তার আনার ব্যবস্থা করো।’ বরষা নিরুপায় হয়ে ঝড়
বৃষ্টি মাথায় নিয়েই অতো রাতে রতনের দরজায় গিয়ে হাজির।
রতন? রতন? দরজা খুলো...।
সামনে এইচএসসি পরীক্ষা থাকায় ভালো
ফলাফলের আশায় রতন তখনও পড়তেছিল। কারণ প্রেম ভালোবাসা যাই করুক না কেনো তাদের দু’জনেরই
লক্ষ্য ছিল ভালো ফলাফলের মাধ্যমে বিসিএস ক্যাডার বা ডাক্তারী পড়ে নিজেদেরকে
প্রতিষ্ঠিত করা ও সমাজের কল্যাণে কাজ করা।
দরজা খুলে রতন রীতিমত হতবাক! এ যেন
মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে, ‘বরষা এতো রাতে তুমি?
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কী করে এলে? কেনইবা এলে? কোনো বিপদ ঘটেনি তো?’
ততোক্ষণে কথার শব্দ পেয়ে রতনের
গার্ডিয়ান জেগে ওঠে এবং রতনের কক্ষে এসে এতোরাতে বরষাকে দেখে কটাক্ষ করলেন! মায়ের
অসুস্থতার কথা বলে সারতে না পেরেই অপবাদ নিয়ে চোখের জলে নির্বাক বেরিয়ে গেলো সে।
কিন্তু বৃষ্টির জলে ভেজা মুখে মিশে যাওয়া অশ্রুজল কি দেখতে পেয়েছিলো রতন বা তার
বাবা মা?
বাহিরে বিজলি চমকানো আকাশে প্রচণ্ড
বজ্রপাত। তার মধ্যেও ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়িতে দৌড়ে যায় একাই মাকে ডাক্তারের
কাছে নিয়ে যাবে বলে। কিন্তু ততোক্ষণে তার মা চিকিৎসার অভাবে না ফেরার দেশে চলে
গেছে।
ভোর হতেই মহল্লায় বিভিন্নজনের মুখে
রটতে থাকে এই আষাঢ় মাইসা বৃষ্টির মধ্যে সুযোগ নিয়া মাইয়াডা কি নির্লজ্জ কামডাই-না
ঘডাইছে! এ মহল্লার মান ইজ্জত খাইছে! ছি! ছি! গলায় দড়ি দিয়া মা মাইয়ার মরা উচিৎ।
এগো আর এ মহল্লায় ভাড়া থাকতে দেয়া যাবে না। (অথচ ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়াও বরষা ঘন
আষাঢ়ের রাতে রতনের বাসায় এসেছিল, রতনকে নিয়ে মায়ের জন্য ডাক্তার ডাকতে যাবে বলে!)
অন্যদিকে ফজর নামাজ শেষে মসজিদের মাইকে প্রচারিত হচ্ছিল—‘আজ এ আষাঢ়ের রাতে ভাড়াটিয়া বরষার মা অসুস্থ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগ করেছেন—ইন্নালিল্লাহ...।
শোক সংবাদটি শোনার পর রতন ও তার বাবা-মা অপরাধ বোধে পাথর হয়ে একে অপরের দিকে
তাকিয়ে রইল। কেউ কোনো কথা বলতে পারলো না।