বাংলা কবিতা বিনির্মাণে ভাব-অভাব-উপলব্ধি
খান মেহেদী মিজান
বাংলা কবিতার বিপুল সম্ভার বিশ্বের
অন্যান্য জাতির জন্য ঈর্ষার কারণ হতে পারে। এ ভাষায় অসংখ্য কবি অজস্র কবিতা
লিখেছেন। যা মৌলিকত্বে কালোত্তীর্ণ। কবিতার সৌন্দর্য চিরায়ত, আবেদন অবিনশ্বর।
কবিদের মননশীলতা তাই কুর্ণিশযোগ্য। কবিতা মানুষের সুকুমার মনের আবেগমাখা মাধুর্য।
কবিতায় মানুষ বিদ্রোহী মনের ছন্দময় প্রকাশ ঘটায়। কখনো কখনো কবিতা সমাজ বিনির্মাণে
ব্যবহৃত হয়। আর সময়ের প্রয়োজনে সভ্যতার সৃষ্টিতে ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে সমাজ
পরিবর্তনের হাতিয়ারের মর্যাদাও লাভ করেছে। কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ছন্দের
ব্যাপারটা অনিবার্যভাবে এসে পড়ে। ছন্দ ছাড়া মূলত কোনো ভালোমানের কবিতা সৃষ্টি করা
যায় না। তবে ছন্দ মানে শুধু অন্তমিলের ছড়া বা পদ্য নয়। গদ্যছন্দ বলে একটা ছন্দ আছে
এবং সমর সেনসহ অনেক বিখ্যাত কবিই গদ্যছন্দে লিখেছেন। তবে আমি মনে করি ছন্দের
প্রয়োজন কখনোই ফুরোয়নি আর ফুরোবেও না। কবিতায় আমরা যে দোলা বা স্পন্দের কথা বলি তা
এই ছন্দ থেকেই আসে। ছন্দ মানে বিষয়, আঙ্গিক, উপমা, উপাদান ও উৎপ্রেক্ষার
ধারাবাহিকতা ও বিন্যাস।
বর্তমানের আধুনিক কবিতা বলতে মূলত
গদ্য কবিতাকেই বুঝায়। তবে এখানেও কিন্তু ছন্দের দ্যোতকতা-দোলা বা ছোঁয়া আছে। বিশেষ
করে এসব কবিতা আবৃত্তি শিল্পের উপাদান হিসেবে প্রকাশ করার সুযোগ ও গ্রহণযোগ্যতা
বেশি থাকলেও সাধারণ পাঠক বা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে আয়ত্ব করা খুব কঠিন হয়ে
দাঁড়িয়েছে। শ্রেণি ভিত্তিক পাঠ্যপুস্তকে বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত গদ্য
কবিতা দুর্বোধ্য পাঠ হওয়ায় আজকাল শিক্ষার্থীসহ সকল স্তরের পাঠকের কাছে কবিতা পড়া
অনীহার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ গদ্য কবিতা পাঠ করতে গেলেই বুঝবেন কিসের যেন
ঘাটতি, কোথায় যেন ছন্দপতনের সুর কানে এসে লাগছে। এক সময় শ্রেণি শিক্ষার্থী ছাড়াও
একজন সাধারণ পাঠক বা শ্রোতা নিজে পড়তে না পারলেও মুগ্ধ হয়ে অন্যের কবিতা পড়া
শুনতো। আর গ্রামে-গঞ্জেতো পুঁথি কবিতা পাঠের আসর বসে যেতো। কোন একটির অভাবে যেন আজ
আর তা হয়ে ওঠছে না।
কুপি জ্বালানো ঘরে একজন কবি মনের
যন্ত্রণায় যখন কবিতা লেখে, সে জানে এ লেখায় কোন অর্থ নেই, সম্মান নেই, ক্ষেত্র
ভেদে কাব্যগ্রন্থ আকারে কোন সংকলন প্রকাশিত হবার ক্ষীণ সম্ভাবনাও নেই। তবু পল্লী
কবি লিখে চলেছেন। মনে অনেক যন্ত্রণা তবু লেখালেখি। বউয়ের বকুনি, সমাজের অবজ্ঞা,
পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের অবহেলা; তবু চলে কবিতা লেখার মহড়া। কারণ একটি কবিতার
সৃষ্টি একজন কবির কাছে একটি প্রসব বেদনার মতোই।
“আধুনিক কালে কবিতা অবশ্য তার চরিত্র বদলিয়েছে।
আবেগের চেয়ে সেখানে চিন্তার গভীরতা ও শব্দের কারুকাজের উপস্থিতি বেশি। মেধাশূন্য
বা কম মেধার পাঠকের পক্ষে এ ধরনের কবিতা উপভোগ করা কখনো সম্ভব হয় না।”
কতজন আমরা খোঁজ বা হিসেব রাখি সেসব
নিভৃত কবিদের। এ দেশে সে সংগঠনই বা ক’টি যারা নির্বিশেষে অবহেলিত কবিকূলে উন্মুক্ত
সম্মান দিয়েছে? উপরন্তু ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয় ‘এ দেশে কাকের চেয়ে নাকি কবির সংখ্যা
বেশি!’
অনেকে বলে থাকেন-প্রযুক্তির ছড়াছড়িতে
কবিতার ভাবের আবেদন ক্রমেই কমে আসছে। কিন্তু এটা তো হবার নয়। কারণ মানুষ যে স্বভাব
কবি। প্রয়োজনে সমৃদ্ধ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পারফিউমকে আশ্রয় করে কবিতা লেখা যাবে।
প্রযুক্তি নির্ভর পৃথিবী বরং কবিকূলের আবেগকে করছে তাড়িত, হচ্ছে বেগবান, পাচ্ছে
বৈচিত্রতা।
কবিতা সেই জিনিস যা কখনো গানের মতো
গেয়ে বেড়ানোর প্রয়োজন নেই, অভিনেতার মতো হাত-পা ঝাঁকিয়ে অভিনয় বা আবৃত্তি করার
প্রয়োজন নেই। পাণ্ডিত্য জাহিরে দুর্বোধ্য ভাষায় রচনার প্রয়োজন নেই। কেবল পাঠ করতে
পারলেই চলে। তবে কখনো কখনো কবিতা আবৃত্তি বা গীতযোগ্য বটে; কিন্তু এ কথা অবলীলায়
বলা যায় যে, কবিতা এসব উদ্দেশ্যে রচিত হয় না। কবিতার মধ্যে এমন একটা যাদু থাকে যা
কোনো সুর ছাড়াই পাঠককে বিমোহিত করে। কবিতা শব্দ দিয়ে গাঁথা হলেও শব্দগুলো পঠিত হওয়ার
পর এটা মস্তিষ্কের সিঁড়িদরজা পার হয়ে সোজা পাঠকের হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করে। সে আঘাতে
ঘুমন্ত হৃদয়টা হঠাৎ আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে কিংবা বটের পাতার মতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে
পতপত করে নড়ে ওঠে। বড় কবি তারাই যাদের লেখার মধ্যে এ ধরনের শক্তি থাকে।
আধুনিক কালে কবিতা অবশ্য তার চরিত্র
বদলিয়েছে। আবেগের চেয়ে সেখানে চিন্তার গভীরতা ও শব্দের কারুকাজের উপস্থিতি বেশি।
মেধাশূন্য বা কম মেধার পাঠকের পক্ষে এ ধরনের কবিতা উপভোগ করা কখনো সম্ভব হয় না। টি.এস
এলিয়টের ‘দ্য ওয়েষ্ট ল্যান্ড’
কিংবা ডব্লিউ বি ইয়েটসের ‘সেইলিং টু বাইজান্টিয়াম’ উপভোগ করা আর এস টি কোলরিজের ‘দ্য
রাইম অব দ্য এনসিয়েন্ট ম্যারিনার’ উপভোগ করা এক কথা নয়।
আবৃত্তির কথায় যদি আসি: অনেক দুর্বল
কবিতাও দরাজ গলায় আবৃত্তি করে স্টেজ গরম করিয়ে দেয়া যায়। সাধারণ শ্রোতা যারা, তারা
চায় শুধু কানের আরাম; শুনতে ভালো লাগলেই তাদের চলে। জসীম উদ্দিনের কবর কবিতা
আবৃত্তি শুনে হয়তো অনেকের চোখে পানি এসে যেতে পারে, তাই বলে এটাই কিন্তু শ্রেষ্ঠ
কবিতা নয়। মূলত হৃদয়ের কান ও বোধশক্তি একসাথে না খুললে কবিতা উপলব্দি করা সম্ভব হয়
না।
কবিতাকে কখনো গানের মত হালকা জ্ঞান
করা সমীচীন নয়। কারো কারো কবিতা আছে যেখানে দুর্বোধ্য ভাষার সংযোজন আবার কারো
কবিতা আছে যেখানে ব্যান্ডসঙ্গীতের চীৎকার ও পাখির কিচিরমিচিরই বেশি; কারো কারো
কবিতা আছে যেখানে সুর লুকিয়ে থাকে কবিতার শরীরের অন্তরালে। শরীর মরে যায় কিন্তু
হৃদয় অবিনশ্বর; কবিতার শরীরের অন্তরালের সুরও বেঁচে থাকে চিরদিন পাঠকের অন্তরে।
কবিতাও তাজমহলের মত শরীরে-পোশাকে সুন্দর হয়ে উঠতে চায় বটে, তবে তাজমহলের আসল
সৌন্দর্য লুকায়িত যে-প্রেমের জয়গানে, কবিতার শারীরিক সৌন্দর্য ছাপিয়েও অন্তরের এই
শিল্পসৌন্দর্যই এখানে ফুটে ওঠে বেশি। যাঁর কবিতায় এ ধরনের সৌন্দর্যের সাক্ষাৎ
মেলে, তাঁর কবিতাই সুন্দর, তাঁর কবিতাই জীবন্ত, তা কখনো মরে না, অমর বৃক্ষ হয়ে তা
ফুলের সতেজ ঘ্রাণ ছড়াতে থাকে কালের বাতাসে। কবিতার জন্য কি গদ্যের মতো সুলিখিত অর্থবহুল
ব্যাকরণজনিত ভুলত্রুটিমুক্ত হওয়া আবশ্যক? কখনো কখনো এর ব্যত্যয় ঘটলেও অধিকাংশ
ক্ষেত্রেই এ সবের আবশ্যকতা আছে। পৃথিবীর সব শ্রেষ্ঠ কবিতাই এদের শরীরজুড়ে অন্তমিল,
ছন্দ ও অলংকারের বাড়তি ব্যবহার থাকলেও গদ্যের মতো একটানা পাঠ করা যায় এবং তা
সহজবোধ্যও বটে।
অনেক কবি এবং কবিতা বোদ্ধাগণ কবিতা
রচনার সময়কে দশকে বিভাজন করেছেন। কিন্তু আমি মনে করি কবিতার কোনো দশক নেই। কবিতা
কালোত্তীর্ণ। সে সময়কে ধারণ করে বিষয়, বৈশিষ্ট ও আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে। তাই যদি না
হয় তাহলে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে কোন দশকের কবি বলে আখ্যায়িত করা হবে? তাঁরাতো সকল
কালকে অতিক্রম করে শতক ছাপিয়ে স্থান করে আছেন সর্বকালের জয়জয়কারে। আসলে কবিতা
শব্দটির শুনলেই একসময় একটু আবেগ-ভাব-মিল অর্থাৎ ছন্দ কথাটি সহজে বুঝা যেত, যা-তে
আজ আর আগের মত টানে না। তাই প্রশ্ন আসে- ‘কবিতাটি কেমন হওয়া চাই?
কবিতাটি এমন হওয়া চাই-
শব্দে গুঢ় অর্থ রবে
ছন্দে রবে ঠাঁই’
মাতৃভাষা শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রবাদ আছে ‘আগে
চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি তার পর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন’ তেমনি আমরা যদি কোনো
গন্তব্যে পৌঁছতে চাই আগে শুরু করতে হবে যাত্রা এর পর বন্ধুর পথ চলা, সব শেষে
বিশ্রাম। কোনো আসবাবপত্র তৈরি করতে হলে শুরুতেই একটি আকার বা স্যাপ দিতে হবে তার
পর ফিনিশিং। তদ্রুপ কবিতা রচনা করতে গেলে আমার মতে প্রথমে ভাব, বিষয়, আঙ্গিক, উপমা
ও উপাদান বিন্যাসে একটি বর্ণনার ফ্রেমে তুলে ধরতে হবে। তারপর কেটে-ছেঁটে অন্তমিল
বা মাত্রাবৃত্তে দাঁড় করাতে হবে। তাই আগে চাই লেখার ফরমেট তারপর ছন্দ বা মাত্রা।
অর্থাৎ শুরুতেই মাত্রা নিয়ে ভাবলে লেখাটিই তৈরি না হতে পারে।
বাংলা কবিতার ছন্দকে মোটামুটি তিন
ধরনের ধরে নেয়া হয়। যেমন-অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্ত। তবে মাত্রা
বিচারের রীতি ভেদে ছন্দও পাল্টে যায়। মাপামাপির ক্ষেত্রে জল লিটারে, কাপড় বা কঠিন
বস্তু মিটারে মাপলেও কবিতার ছন্দ মাপা হয় মাত্রায়। কবিতার এক-একটি পংক্তির মধ্যে
যে ধ্বনিপ্রবাহ থাকে এবং তাকে উচ্চারণ করার জন্য যে সময়টুকু আমরা নিয়ে থাকি, সেই
উচ্চারণকালের ক্ষুদ্রতম এক-একটা অংশই হল মাত্রা। বাংলা কবিতার ছন্দ খুবই বনেদি। রবীন্দ্রকাব্যের
সূচনাপর্বেও বাংলা কবিতা প্রধানত অক্ষরবৃত্তেই লেখা হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত
অক্ষরবৃত্তই শীর্ষ স্থান দখল করে আছে। অক্ষর বৃত্তের মাত্রা গণনার নিয়ম এই যে, এ
ছন্দে যত অক্ষর বা বর্ণ, তত মাত্রা অর্থাৎ প্রতিটি অক্ষরই এখানে ১ মাত্রার মর্যাদা
পেয়েছে। বাংলা অক্ষরের উপরে যে মাত্রা দেয়া আছে তাকেই আমরা মাত্রা বলি। যথা- অ, ত
এদের উপর মাত্রা দেয়া আছে সুতরাং এটি ১ মাত্রা। আবার স্ক, ল্ল বা উজ্জ্বল এর জ্জ
যুক্তাক্ষর হলেও এটি একমাত্রা, ৎ মাত্রা নেই তাই উৎফুল্ল এতে ৩ মাত্রা, হঠাৎ এটি ২
মাত্রা। তবে স্বরবর্ণে এ এবং ও অক্ষরে মাত্রা না থাকলেও একমাত্রা ধরা হয় যেমন-এসো-
২ মাত্রা, এখন- ৩ মাত্রা। আবার কখনো ও তে শূন্য মাত্রা ধরা হয় যেমন-হাওয়া, খাওয়া- ২
মাত্রা ধরলে ও শূন্য মাত্রা। ব্যঞ্জনবর্ণে ঙ, ৎ মাত্রাহীন হলেও যদি শব্দের শেষে
বসে বা যুক্তাক্ষর হিসেবে বসে সে ক্ষেত্রে তা একমাত্রা বলে গণ্য হয়। যেমন- রঙ- ২ মাত্রা,
হঠাৎ- ৩ মাত্রা, কঙ্কাল- ৩ মাত্রা, অঙ্ক- ২ মাত্রা। এভাবে বিভিন্ন ব্যাকরণবিদ বা
পন্ডিতগণ ছন্দ এবং মাত্রার বর্ণনা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। (চলবে)
লেখক: কবি, সম্পাদক ও প্রধান শিক্ষক।