বর্ষণের সংসার
ফকির শাহিন শাহ্
কী হবে সংসার করে! জীবনটা তো অল্প কয়েক দিনের। জীবনের এ অল্প কয়টা
দিন চাইলে এভাবেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। মানুষ খামাখা সংসার করে, পরের তরে বয়ে বেড়ায় বোঝা।
কী আছে সংসারে! কিচ্ছু নেই শোক-তাপ ছাড়া। তবুও মানুষ সংসারের পিছু ছুটে, খুঁজে ফিরে
সুখ।
জীবন থেকে চব্বিশ বছর চলে গেছে এশা মিয়ার,
সেই চিন্তায় এশা মিয়া জবুথবু। আর চব্বিশ বছর কি তিনি বাঁচবেন! জীবনের চব্বিশ বছর খামাখাই
কেটে গেছে, কী সঞ্চয় করেছে জীবনের জন্য! কতটুকু হয়েছে মুক্ত! এই ভাবনায় তিনি সংসারমুখি
হতে চান না।
গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি; তার মধ্যে দুই কাঁধে
দুইটা বাঁশ নিয়ে লতাপাতার ভেতর দিয়ে হেঁটে আসছে এশা মিয়া। বাঁশ দুইটা কাঁধ থেকে ধপাস
করে মাটিতে নামিয়ে, শাবলটা হাতে নিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগলো। চার কোণে চারটা গর্ত খুঁড়লো,
চারটা বাঁশের খুঁটি গেড়ে তৈরি করলো বাঁশের মাচা। মাচার সাথেই একটা কদম গাছ, এশা মিয়া
গাছটা ঘেঁষেই মাচাটা তৈরি করলো। মাচায় বসে যেন গাছের সাথে হেলান দেওয়া যায়। মাচা তৈরি
শেষে এবার এশা মিয়া মাচায় উঠে কদম গাছটির সাথে হেলান দিয়ে বসে, একটা শান্তির নিশ্বাস
ছাড়লো। মাথাটা দুই দিকে ঝাঁকি দিয়ে ভেজা ভেজা চুলগুলো খোঁপা করে বাঁধলো। চারিদিকে লতাপাতা
কী সুন্দর সবুজ হয়ে আছে বৃষ্টির জলে ধুয়ে, কত রকমের লতাপাতা গাছগাছালি আছে এখানে তা
বলার মতো না। এই জায়গাটা একটা বসত বাড়ির ভিটা। এক সময় এখানে বাড়ি ছিলো, আজ নাই। আজ
জঙ্গলে ঘেরা। এখানে বসলে বাইরের কিছুই দেখা যায় না জঙ্গল ছাড়া। পশু-পাখি, তরুলতা, কীটপতঙ্গ-
জন্ম কিংবা বাস করতে পারে যে কোনো স্থানে, অনুমতি খাজনা ছাড়া। শুধু মানুষই পারে না।
২
আর আধঘন্টা পর মাগরিবের আজান দিবে। আকাশটা
এখন ভালোই ফর্সা, ফর্সা ও ফুরফুরে এশা মিয়ার মন। এশা মিয়া মাচার উপর চিত হয়ে শুয়ে কদম
গাছে ঝুলে থাকা, কদম ফুলগুলো দেখছে। আর একটা কদম ফুল, কদম ফল থেকে আলাদা করে, ফুলের
পাপড়িগুলো উপরে ছুঁড়ে মারছে। পাপড়িগুলো ঝরঝর করে এসে পড়ছে চোখে, মুখে ও বুকে। কী সুখ,
কী আনন্দ এশা মিয়ার মনে! এশা মিয়া কদম গাছকে বলছে, ফের জন্মে আমি কদম ফুল হবো, না কদম
গাছ হবো। না না, বৃষ্টি ভেজা কদম ফুল হবো, নাহ্ এতেও আমার মন ভরবে না। আমি হবো, আমি
হবো বর্ষা, শরৎ। শীত, হেমন্ত, বসন্ত, গ্রীষ্ম সব। সব হবো আমি। বলেই অট্টহাসি হাসে এশা
মিয়া। কী ভেবে জেনো হটাৎ চুপ হয়ে গেলো, একদম চুপ হয়ে আছে এশা। পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশটা
দেখা যাচ্ছে, একটা বাঁশপাতি পাখি ডাকছে ঝোপের মধ্যে। পাখির ডাক শুনে আবার বলতে লাগলো,
আগামীতে আমি পাখি হবো। সেই জীবনে সংসার বাঁধবো ঝোপঝাড়ের মধ্যে। তখন সংসার করলে পাপ
হবে না। পাখির তো পাপ পূর্ণ নাই, মানুষের আছে। শালার পাপ পূর্ণ... আবার অট্ট হাসি হাসে
এশা।
হাসির শব্দ পেয়ে ঝোপের ওই পাশ থেকে জহু
আলী ডেকে বললো, কেডা ওই হানে? এমন হাসে কেডা?
-আমি, আমি এশা মিয়া। কে জহু ভাই?
-হ রে এশা।
-ওই হানে কী করো জহু ভাই?
-জাল পাতি।
-হেনে মাছ আইবো? -
-পাইত্তা দেহি।
-তোমার জালে মাছ না হাপ... হাপ বাজবো।
আহো, হেনে আহো।
-না রে জাইগা, আরো জাল পাততে অইবো।
-পানি আরো বলবো নি জহু ভাই?
-হ পানি বলবো, বন্যা অইবো।
৩
গত দুই দিনে এতটাই পানি বেড়েছে যা বলার
মতো না। গ্রামগঞ্জ, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার অনেক বাড়ির উঠোনেও পানি। তার সাথে ঝুম বৃষ্টি।
এ বছর সব আবর্জনা ধুয়ে নিয়ে যাবে বর্ষা, পিপাসা মিটবে সমস্ত সৃষ্টি আদির। এশা মিয়ার
মাচা ছুঁইছুঁই পানি, মাচায় আসতে হাঁটুর উপর পানি সাঁতরায়ে আসতে হয়। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি,
তার মধ্যে এক হাঁটু পানি সাঁতরায়ে এসে উঠলো মাচায় এশা মিয়া। মাচায় বসে পা দুটো পানির
মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে, মাচায় বসে বৃষ্টিতে ভিজতেছে এশা। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পাতা চুয়ে পড়ছে
পানিতে। সাপ, গুইসাপ, ডাহুক এক ঝাঁক বাচ্চা নিয়ে পানি সাঁতরায়ে ঝোপের মধ্যে যাচ্ছে।
চারিদিক মানব শূন্য, শুধু প্রকৃতি ছাড়া এখানে আর কিছুই নেই। অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরে
যাচ্ছে, অনেক জংলা গাছ বর্ষার পানিতে দেহ ডুবিয়ে মাথা উঁচু করে আছে। জংলা গাছের মাথায়
গড়েছে ছোট্ট সংসার পৃথিবীর সবচেয়ে কর্মঠ প্রাণী পিপড়া, বর্ষা চলে গেলেই তাদের বিচরণ
হবে ভূমিতে। এ যেন এক অদ্ভুত খেলা চলছে, আর এ খেলা দেখছে এশা। এশা যেন পৃথিবীর আদিম
পুরুষ। মাতা হাওয়াহীন সেই হজরতে আদম! সময় যায় বৃষ্টি থামে না, সময়ের সাথে সাথে জোট
বেঁধে যেন সময়ের গতিতেই ঝরছে তুমুল শব্দে বৃষ্টি। পিপাসা মিটিয়ে নিচ্ছে সমস্ত সৃষ্টি
আদি, এক ঝাঁক বাচ্চা নিয়ে আনন্দে মেতে উঠছে ডাহুক। এমন মুক্ত জীবনই তো চেয়েছিলো এশা,
যখন ইচ্ছে প্রকৃতিতে মেশা যাবে, যখন ইচ্ছে শিশুদের মতো খেলতে পারবে বর্ষার পানিতে।
এশার চিন্তাধারাই ঠিক, প্রকৃতি থেকে এসেছি প্রকৃতিতেই আবার মিশবো। খামাখা ভোগবাজির
সংসারে বন্দি হয়ে এই প্রকৃতি মাতাকে ভুলে যাওয়া উচিৎ না। ভোগবিলাসে না জড়িয়ে, মানুষ
চাইলে জীবনের এই অল্পকয়টা দিন, তসবি গোনার মতো গুনেগুনেই শেষ করে দিতে পারে। এশা মিয়া
হাত দুটো মোনাজাতের মতো করে বৃষ্টির পানি হাতে জমা করছে, জমা করে চোখে মুখে ছিটায়,
আবার জমা করে। এশা হাতে জমাট পানির দিকে তাকিয়ে পানিকে বলে, পানি তুমি বড় প্রিয় বস্তু,
তোমাকে দিয়ে শুকনো মাটি ভিজিয়ে নেয় তার জঠর, বৃক্ষ ধুয়ে নেয় তার পাতা, আল্লাহ্ প্রেমিক
তোমাকে দিয়ে অজু করে পবিত্র করে দেহ। তুমি কত বড় নেয়ামত। আচ্ছা পানি তোমাকে দিয়ে দেহ
ধুলে কি মন পবিত্র হয়? তুমি কি মন পবিত্র করতে পারো? তা পারো না, তা পারো না। অট্ট
হাসি হেসে মাচা থেকে নেমে সাঁতরাতে থাকে পানিতে এশা। সাঁতরাতে সাঁতরাতে এ ডাল ধরে,
আবার কখনো ও ডাল ধরে, পা দাপড়ায়ে সাঁতরায় এশা।
8
এখন অবশ্য বৃষ্টি নাই, নামতেই বা কতক্ষণ।
দুইটা জং ধরা টিন এনে মাচার উপরে চাল দিয়েছে এশা মিয়া, যাতে বৃষ্টির মধ্যেও না ভিজে
থাকা যায়। শ্রাবণ মাস তবুও আজকে কড়া রোদ উঠেছে, চারিদিকে থইথই পানি আর কড়া রোদ। মাচায়
বসে মুড়ি খাচ্ছে এশা মিয়া, হালকা হলদে রঙের কালো পানিতে দেখা যাচ্ছে গুঁড়া পোনামাছ।
এশা মুড়ি খায় আর কিছু মুড়ি ছিটিয়ে দেয় পানিতে, পোনামাছগুলো খাবার পেয়ে ঝাঁক বেঁধে এসে
ঠুকরে ঠুকরে খায়। ছোটো কিংবা বড়, পৃথিবীর সব প্রাণীই চায় একটু সুখ, একটু শান্তি। পৃথিবীর
অনেকেই সুখে থাকে কিন্তু শান্তিতে থাকে অনেক কম লোকেই। এশা মিয়ার ধারণা শান্তিতে থাকার
একমাত্র উপায় হচ্ছে ধ্যান বা মেডিটেশন। এই ধ্যানই পারে সব ভুলিয়ে দিয়ে অনাবিল প্রশান্তি,
মন ও মস্তিষ্কে দিতে। এশা মিয়ার ধারণা, এই পৃথিবী সৃষ্টির আগে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আপনার
ধ্যানে মগ্ন থেকেই, চিন্তা গবেষণা করেই সৃষ্টি করেছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। যত ধ্যান তত
জ্ঞান, যত ধ্যান তত প্রশান্তি। তাই এশা মিয়া টুপটাপ বৃষ্টির মধ্যে মাচার উপরে একটা
কাপড় বিছিয়ে, পদ্মাসনে বসে চেয়ে আছে নীরবে। বৃষ্টি পড়ছে, এশা অবলোকন করছে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো,
কী অপরুপ সৌন্দর্যে ঝরে পড়ছে আপন মহিমায়। এভাবে মিনিট পাঁচেক অবলোকন করে, ধীরে ধীরে
চোখ বুজে এশা। টুপটাপ বৃষ্টির শব্দে তলিয়ে যায় এশা মিয়া শান্তির ঘরে, ভাসতে থাকে শূন্যে
মহাশূন্যে!
চলেই যদি যায় তবে কেনো যে আসে ক্ষণিকের
জন্য। জীবন, সংসার এ সব কিছুই ক্ষণিকের, বর্ষা-শরৎ, শীত-বসন্ত, পৃথিবীর সব কিছুই ক্ষণিকের।
চিরস্থায়ী কিছুই নয়। তেমনি ক্ষণিক সময়ের জন্য এসেছিলো বর্ষা, আবার চলে যাচ্ছে। গত একদিনে
অনেক পানি কমে গেছে, মনে হয় আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সব জেগে উঠবে মাথা নাড়া দিয়ে, জেগে
উঠবে পানিতে তলিয়ে যাওয়া পঁচা লতাপাতা, ঘাস, শামুক। নিয়তি আসার জন্য পথ করেছেন লম্বা,
যাওয়ার পথ করেছেন ছোটো। তাই সব কিছুই আসতে দেরি হয়, যেতে দেরি হয় না। জীবন থেকে সব
কিছুই তারাতাড়ি চলে যায়, যেমন চলে যাচ্ছে এশার জীবন থেকে বর্ষা। বর্ষা চলে গেছে এক
সপ্তাহ হলো। এক সপ্তাহ পর এশা মিয়া দাঁড়িয়ে আছে মাচার সামনে। বর্ষা চলে গেছে রেখে গেছে
কিছু স্মৃতি। প্রতিটা গাছ, লতাপাতার গোড়ায় লেগে আছে পানির চিহ্ন, পড়ে আছে পঁচা শামুকের
খোল। মাচাটা পড়ে আছে শুকনোয়, চারিদিকে কেমন ধোয়া ধোয়া শূন্য খাঁখাঁ। মাচার একটা খুঁটি
পেঁচিয়ে চালে উঠেছে জংলা লতা, শরতের শুভ্র আকাশের সাথে করছে কথোপকথন লতাটি। এশা মিয়া
দাঁড়িয়ে ভাবছে আর কোনো বর্ষা কী পাবো জীবনে, শীত কিংবা বসন্ত! জীবন তো ফুরিয়ে যাচ্ছে।
যদি পাই বর্ষা-শরৎ, কিংবা শীত-বসন্ত, তাহলে এভাবেই প্রকৃতির মাঝে একাকীত্বের সংসার
গড়ে কাটিয়ে দিবো, জীবনের এই কয়টা গনার দিন, কাটিয়ে দিবো সংসারহীন। সে আশাতেই এশা মিয়া
তাকিয়ে থাকে মাচাটির দিকে। তাকিয়ে থাকে শরতের আকাশের সাথে দোল খাওয়া লতাটির দিকে, অন্য
কোনো বর্ষা কিংবা শীত, বসন্তের অপেক্ষায়। লতাটি কি সুন্দর আপন মহিমায় কথা বলে যাচ্ছে,
মাচাটির চালে শরতের শুভ্র আকাশের সাথে। কদম গাছটি দাঁড়িয়ে আছে যৌবন হারিয়ে।