পদ্মা সেতু : উন্নয়নের
মহাসড়কে শরীয়তপুর
ইয়াসিন
আযীয
বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনা ও মহাসমারোহে গত ২৫ জুন, ২০২২ উদ্বোধন করা হয় পদ্মা সেতু। ৬.১৫ কি.মি. দৈর্ঘ্যের ও ১৮.১৮ মিটার প্রন্থের এবং ৩০,১৯৩ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত পদ্মা বহুমুখী সেতু বাহ্যিক দৃষ্টিতে মুন্সিগঞ্জ এবং শরীয়তপুর জেলাকে সংযুক্ত করেছে প্রতীয়মান হলেও এটা মূলত রাজধানীর সাথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে সংযুক্ত করেছে এক সুতোয়। বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা ও প্রলয়ংকারী পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে এদেশের মানুষের গুটিগুটি পায়ে হেঁটে যাওয়ার কল্পনাতীত স্বপ্ন সত্যি হয়েছে এবং বাংলাদেশের মানুষের অনেক বড় স্বপ্নপূরণ হয়েছে এর মাধ্যমে। প্রমত্তা পদ্মাকে বশে এনে এর বুকের গভীরে খুঁটি গাড়া, যা কয়েকদশক আগেও চিন্তা করা কঠিন ছিল! পদ্মা সেতু দুঃসাধ্য সাধনের নাম, পদ্মা সেতু ইস্পাত-কঠিন দৃঢ় মনোবলের ফরমান। কীর্তিনাশার বুকে প্রস্ফুটিত অপার বিস্ময়ই শুধু নয়; বিশ্বের দরবারে একটি দেশের মাত্র নয়মাসে স্বাধীনতা অর্জনের মতোই পদ্মা সেতু বিশ্বের বিস্ময় এবং আমাদের অহংকার—এতে কোনো সন্দেহ নেই। একটু পিছনে ফিরে গেলে দেখবো, একসময় এ অঞ্চল ছিল বিক্রমপুরের অধীন। তখন পদ্মা-মেঘনার সংযোগকারী ছোট্ট নদী কালীগঙ্গা বিক্রমপুরকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছিল। শরীয়তপুর ছিল দক্ষিণ বিক্রমপুরের অংশ। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পদ্মা দিক পরিবর্তন করে বর্তমান শরীয়তপুর ও মুন্সিগঞ্জের মাঝ দিয়ে বিপুল শক্তিতে কালীগঙ্গা হয়ে দুই পাড়ের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ জনপদের সব কীর্তি তছনছ করে ফুলে ফেঁপে মেঘনার সাথে মিলিত হয়। ফলে উত্তর ও দক্ষিণ বিক্রমপুর চিরতরে আলাদা হয়ে যায় এবং পদ্মা খ্যাত হয় নয়াভাংগনী বা কীর্তিনাশা নামে। এই সেতুর ফলে উত্তাল পদ্মার দু’পাড় সংযুক্ত হলো। ২০১২ সালে নির্মাণ কাজ শুরুর কথা থাকলেও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতাসংস্থা ঋণচুক্তি বাতিল করে। ফলে আমরা চরমভাবে আশাহত হই। তখন প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিলে দেশ-বিদেশে হইচই পড়ে যায়। ২৬ নভেম্বর, ২০১৪ নিজস্ব অর্থায়নেই মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কাজ শুরুর পর থেকে প্রাকৃতিক ও প্রযুক্তিগত অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হয় সেতু নির্মাণে। সেসব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে নির্মাণকাজ সমাপ্ত পর্যন্ত অনেক বিশ্বরেকর্ড হয়েছে পদ্মা সেতুতে। বর্ষায় সেকেন্ডে ১৫ লাখ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয় পদ্মায়! সে হিসেবে ২৬ নভেম্বর ২০১৪ থেকে ২৫ জুন ২০২২ পর্যন্ত সময়ে পদ্মা নদী দিয়ে কোটি কোটি ঘনমিটার পানি গড়িয়েছে বঙ্গোপসাগরে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশের কেন্দ্রের সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সরাসরি সংযোগ তৈরি হয়েছে। সেতুটি দেশের পরিবহনব্যবস্থা এবং আঞ্চলিক অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত। যা দক্ষিণের অনুন্নত অঞ্চল শরীয়তপুরের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। ফলে শরীয়তপুরের ১৯ লক্ষাধিক (প্রায়) জনগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে। বহুমুখী দ্বিতল সেতুটিতে রেল, গ্যাস, বৈদ্যুতিক লাইন ও অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল সম্প্রসারণের ব্যবস্থা থাকায় দক্ষিণাঞ্চলের ৩.৫ শতাংশ এবং সমগ্র দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধিপাবে। বিশ্বের দামি (ব্যয়বহুল বলবো না) সেতুগুলোর একটি হচ্ছে পদ্মা সেতু। তাই দামি সেতু হওয়ায় এর পারানি খরচও একটু বেশি। জনগণের টাকায় বা নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত সেতুর পারানি খরচ বেশি ধরায় অনেকে কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি না হওয়ার আশঙ্কা করলেও কেউ কেউ আবার টোল হার সঠিক আছে বলেই মত দিয়েছেন। পদ্মা সেতুতে কতটি পিলার, কতটি পাইল, কতটি স্প্যান বসেছে—এসব বলে সময় নষ্ট করবো না। পদ্মা সেতুর ফলে, সেতুর দক্ষিণ পাড়ের প্রথম জেলা শরীয়তপুরের অর্থনীতিতে এবং এখানে বসবাসরত ১৯ লক্ষ (প্রায়) মানুষের যাপিত জীবনে কী পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে এবং সেতুর সুফল কতটা কিভাবে পৌঁছবে তাদের জীবনে—সেই খোঁজখবরের প্রয়াস রাখছি। তুলে ধরার চেষ্টা করছি বিবিসিসহ বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ এবং বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সাক্ষাৎকারের কিয়দাংশ। প্রকাশিত সংবাদ ও সাক্ষাৎকার পর্যালোচনায় দেখা যায় পরিবহন ও যোগাযোগ, পর্যটন, কৃষি, মৎস্য, গবাদি পশু ও দুগ্ধজাত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প, আবাসন ইত্যাদি খাতগুলোর সম্ভাবনাই সবথেকে বেশি।
পরিবহন ও যোগাযোগ খাত ৩৫ বছরের পুরাতন ও ধুকতে থাকা একটি খাত। অপ্রশস্ত ও ভাঙা রাস্তা, ফেরি পারাপারের ঝামেলা ইত্যাদি কারণে দীর্ঘদিন ঢাকার সাথে সরাসরি বাস যোগাযোগ বন্ধ ছিল। ২৭ কি.মি. চারলেনের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে এবং পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ফলে শরীয়তপুরের পরিবহন ব্যবসায়ীরা আশার আলো দেখছেন। এই খাতে তারা সেতু উদ্বোধনের আগেই ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন বলে জানা যায়। এর সুফলও ভোগ করছি আমরা। আরও বিনিয়োগের অংশ হিসেবে বিভিন্ন জেলার সাথে যোগাযোগ করে ঢাকাসহ নতুন নতুন রুটে এসি, নন-এসি বাস ছাড়ছেন বলে জানান শরীয়তপুর জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি ফারুক আহাম্মদ তালুকদার। কিছুদিন আগে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা গিয়েছিলাম ডাক্তার দেখাতে। শরীয়তপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে চারটার সময় বাস ছাড়ে। ঢাকা পৌঁছে ধানমন্ডি-৯ নম্বরে ডাক্তার দেখিয়ে রাত সোয়া-এগারোটার সময় শরীয়তপুর ফিরি। আগে যা কল্পনাই করা যেত না। কিন্তু পদ্মা সেতুর দক্ষিণ প্রাপ্ত শরীয়তপুরের মধ্যে পরলেও সেতুর সঙ্গে শরীয়তপুরের নতুন সংযোগসড়ক হয়নি। জেলার বিদ্যমান রাস্তারও উন্নতি হয়নি। রাস্তা হলে সদরসহ অন্যান্য উপজেলার সাথে ঢাকা যাতায়াতের সময় আরও কমে যেত। সেতু চালুর পর গত কুরবানির ঈদ উদযাপন করতে আসা যাত্রীদের সরু রাস্তার ভোগান্তি জনমনে অসন্তোষের উদ্রেক ঘটে। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে পৌঁছতে যতটা সময় লাগে তার দ্বিগুণ সময় লাগে শরীয়তপুর আসতে। ফলে তারা শরীয়তপুরের মন্ত্রী, এমপিসহ রাস্তা নির্মাণের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহের প্রতি রাস্তা নির্মাণের দীর্ঘসূত্রিতায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। প্রকল্পের ধীরগতিতে বেড়েছে দুর্ভোগ। ভাঙা ও সরু রাস্তায় চলতে হয় ঝুঁকি নিয়ে। ফলে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। সেতু উদ্বোধনের আগে দুই পাশের সংযোগসড়ক হয়ে গেলেও শরীয়তপুরের ১২ থেকে ১৮ ফুট প্রশস্ত ভাঙা রাস্তার কোন উন্নতি হয়নি! নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করার জন্য জেলার বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন করতে দেখা গেছে বিভিন্ন সময়। মানববন্ধনে অনেকে প্রকল্পের কাজ সেনাবাহিনীর হাতে ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলেন। জাজিরার টিএন্ডটির বাসিন্দা রফিক ওসমান আক্ষেপ করে বলেন—‘বাড়ির পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা দীর্ঘ যানজট লেগেই থাকে। আমাদের জেলায় সেতু হলেও সুফল পাচ্ছে অন্যরা।’
পর্যটন খাত শরীয়তপুরের জন্য নতুন এবং সম্ভাবনাময় খাত। অর্থনীতিবিদরা এই খাতেরই সবথেকে বেশি সম্ভাবনা দেখছেন জেলায়। সিঙ্গাপুর, হংকং ও সাংহাইয়ের মতো সম্ভাবনা দেখছেন অনেকে। আয়তনে হংকং ও সিঙ্গাপুরের চেয়ে সামান্য বড় শরীয়তপুর। পদ্মা-মেঘনা ও আড়িয়াল খাঁ বেষ্টিত এবং কীর্তিনাশা বিধৌত শরীয়তপুর জেলাকে এশিয়ার অন্যতম ওই দুটি বাণিজ্যিক কেন্দ্রের মতো হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিয়ার রহমান। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্রকরে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মা নদী, নদীর পাড় ও চরগুলো পর্যটনশিল্পের জন্য খুবই সম্ভাবনাময় বলে মনে করেন শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো: পারভেজ হাসান। নিউজ বাংলার সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘দুর্দান্ত সম্ভাবনা আছে আমাদের পর্যটনের ক্ষেত্রে। পদ্মা সেতু দেখার জন্য প্রচুর মানুষ আসবে। জাজিরার ‘রূপবাবুরহাট’ চমৎকার একটি জায়গা, যেটি জলমহাল হিসেবে ইজারা দেয়া হয়। এটি মূলত পদ্মার একটি চ্যানেল, যেটি মারা গেছে। আমাদের পরিকল্পনা আছে এর দুইপাড় বাঁধাই করে ফাইভস্টার হোটেল করার। সেখানে গলফ খেলার মাঠ হতে পারে। এত সুন্দর একটি তট তৈরি হয়েছে, যেখানে ওয়াচটাওয়ার করা যেতে পারে সেতু দেখার জন্য। ওখান থেকে মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর জেলার কানেক্টিভিটি রয়েছে। এই অঞ্চল চরট্যুরিজমের জন্য খুবই উপযোগী। নদীপথে যদি আমরা রিভারট্যুরিজমের ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে দর্শনীয় একটি পর্যটনস্পট হতে পারে। জাজিরা প্রান্তে একটি আন্তর্জাতিকমানের স্টেডিয়াম হতে পারে। ঢাকা থেকে বিকেএসপি যেতে যে সময় লাগে, তার চেয়ে জাজিরা আসতে কম সময় লাগবে। শরীয়তপুর জেলা স্টেডিয়াম আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এটিও আন্তর্জাতিকমানের ম্যাচের জন্য অনুশীলন ভেন্যু হতে পারে। ফলে পর্যটনকেন্দ্র এবং স্টেডিয়াম ঘিরে এখানে থ্রি-স্টার মানের হোটেল-মোটেল তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও গোসাইরহাট থেকে শুরুকরে জাজিরা পর্যন্ত পদ্মা নদীর পাশদিয়ে রিভারড্রাইক হবে। ইতিমধ্যে নড়িয়ার অংশে হয়ে গেছে। নড়িয়ায় যে রাস্তা করা হয়েছে সেটাকে জাজিরা পর্যন্ত নিয়ে আসার চিন্তা-ভাবনা চলছে। ফলে সেতু পার হয়ে শরীয়তপুর না গিয়ে রিভারড্রাইভ দিয়ে সরাসরি গোসাইরহাটে চলে যাওয়া যাবে।’ এফবিসিসিআই এর ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য মো. নাসির উদ্দিন বাদল বলেন, ‘আমাদের জেলায় ইতিপূর্বে পর্যটনভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠেনি। জেলা ক্যাটাগরিতে শরীয়তপুর ৬৪ নম্বর জেলা হওয়ায় সার্বিক উন্নয়নে পিছিয়ে আছে। তবে পদ্মা সেতু ঘিরে পর্যটনসহ বিনোদনকেন্দ্রিক অপারসম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পদ্মা সেতুর কারণে জেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল এখন অতিমূল্যবান ও চাহিদাসম্পন্ন ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এ যেন দুর্গম চরাঞ্চল নয়, সম্ভাবনার পরশপাথর। আমরাসহ অনেক কোম্পানি, বিনোদনপ্রেমী ভ্রমণপিপাসুদের জন্য রিসোর্ট করতে জমি খুঁজছেন। তাই সেইদিন খুব বেশি দূরে নয়, শরীয়তপুর হবে বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনসমৃদ্ধ জেলা।’
“পদ্মা সেতু ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ইউরো-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক সিস্টেমের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এশিয়ান হাইওয়ে ও ইউরো-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। উক্ত হাইওয়ে ও রেললাইনের অংশ শরীয়তপুরের ওপর দিয়েই যাবে। তারপরও শরীয়তপুরবাসিকে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে এখনো ফোরলেন সড়কের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। তবে ফোরলেন সড়কটি যদি শরীয়তপুর শহরকে বাইপাস করে অথবা শহরের অংশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করা যেত, তবে সরকারি বেসরকারি অনেক স্থাপনা রক্ষার পাশাপাশি সরকারের পুনর্বাসন ব্যয় অনেক কমে যেত।”
শরীয়তপুরের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত কৃষিখাত। পদ্মা সেতু সেই সম্ভাবনার পালে দিচ্ছে নতুন হাওয়া। আমরা এক সময় যশোরসহ অন্যান্য অঞ্চলের শাকসবজির উপর নির্ভরশীল ছিলাম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাজিরাসহ আশেপাশের এলাকায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ব্যাপকহারে কৃষিপণ্যের চাষাবাদ হচ্ছে। সেসব পণ্য বিক্রির জন্য ‘মিরাশা চাষিবাজার’ নামে একটি পাইকারি বাজারও রয়েছে। সেখান থেকে জেলার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানিসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয় শাকসবজি। অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে অন্য জেলার পাইকাররা শরীয়তপুরে কম আসতো। ফলে এখানকার চাষিরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতো। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ফলে নতুন নতুন ফসল উৎপাদনে আগ্রহ বেড়েছে কৃষকদের মাঝে। কৃষি বিভাগও ফসল উৎপাদনে কৃষকদের পাশে থেকে কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নির্দেশনাসহ ফুলের মতো সম্ভাবনাময় ফসল চাষে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বর্তমানে চাষিরা তাদের উৎপাদিত শাকসবজি দ্রুততম সময়ে বিক্রির পাশাপাশি ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন। গত ০৪ জানুয়ারি ‘মিরাশা চাষিবাজারের’ কাঁচামরিচ, লাউ ও কচুর ১ম চালান সুইজারল্যান্ড পাঠানো হয়। জেলা প্রশাসন কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলের কৃষি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার অংশ হিসেবে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে গতিশীল করতে জাজিরার ‘কালোজিরা মধু’ ব্যান্ডিং করা ও মসলাজাতীয় ফসল সম্প্রসারণে কাজ করছে। আমরা জেনেছি জাজিরায় বেসরকারি পর্যায়ে বেশকিছু হিমাগার হচ্ছে। এছাড়াও শরীয়তপুরে শেখ হাসিনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া, ভবিষ্যতে শরীয়তপুরে কৃষি অর্থনীতির বিপ্লব ঘটবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। যার পুরোটাই ত্বরান্বিত করবে পদ্মা সেতু।
শরীয়তপুরের তিন পাশে পদ্মা, মেঘনা ও আড়িয়াল খাঁ নদী। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে কীর্তিনাশা। রয়েছে অসংখ্য ছোট নদী, খাল-বিল ইত্যাদি। জেলা মৎস্য দপ্তর সূত্রে—১৫ হাজার ৮৪০ হেক্টর এলাকাজুড়ে মাছ ধরা হয়। জেলায় ২ হাজার ৬২৬ হেক্টর জমিতে ১৫ হাজার ১৮২টি মাছের খামার করা হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। এছাড়াও ২৪ হাজার ৯২০ হেক্টর জমির ২২৫টি প্লাবনভূমি ও ১ হাজার ২৭ হেক্টর জমির ৩৩৪টি ধানখেতে মাছ চাষ করা হয়। জেলার ৪ হেক্টর জমিতে ৩০টি গলদা চিংড়ির হ্যাচারি রয়েছে। বছরে ২৮ হাজার ৫৪৩ মেট্রিক টন মাছ চাষ, সাড়ে ৫ হাজার মেট্রিক টন ইলিশের উৎপাদন ও ২ হাজর ৯৫৩ মেট্রিক টন নদীর অন্যান্য মাছের উৎপাদন হয়।’ নদী, খাল-বিল ও খামারে উৎপাদিত এসব মাছ জেলার চাহিদা মিটিয়ে পাঠানো হয় বিভিন্ন জেলায়। যার বাজারমূল্য পাঁচশ থেকে ছয়শ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর ফলে দেশের অন্যতম মৎস্য উৎপাদনকারী এই জেলার মৎস্যখাতের সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়েছে। পদ্মা নদীর জাজিরা, নড়িয়া ও সুরেশ্বর পয়েন্টে আহরিত ইলিশসহ অন্যান্য মাছ এবং খামারে উৎপাদিত মাছ খুবসহজেই পাঠানো যাচ্ছে রাজধানীসহ অন্যান্য জেলায়। তাজা মাছ দ্রুত আড়তে সরবরাহ করতে পারায় এবং পরিবহন খরচ কম হওয়ায় লাভও বেশি হচ্ছে। এতে উপকৃত হচ্ছেন মৎস্য খামারি, ব্যবসায়ী ও জেলেরা। আগে ঢাকা যেতে দীর্ঘসময় ফেরিঘাটে অপেক্ষার কারণে, অপেক্ষমাণ সময়ে গাড়িতে থাকা মাছ অনেক সময় নষ্ট হয়ে যেত। ভোজেশ্বর শিরঙ্গল গ্রামের খামারি আক্তার ছৈয়াল বলেন, ‘আগে আমি মাছের খাবারের অর্ডার দিলে ফেরির কারণে শরীয়তপুর পৌঁছতে পাঁচ-সাত দিন লেগে যেত। এখন সেতুর কারণে দুই দিনেই পেয়ে যাচ্ছি। ফলে সময় ও খরচ সাশ্রয়ের মাধ্যমে ব্যবসার প্রসার ঘটছে।’ জেলার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাছ উৎপাদনে জড়িত। ভবিষ্যতে শরীয়তপুর জেলায় মৎস্যখাতে কর্মসংস্থান বাড়বে বলে অর্থনীতিবিদসহ মৎস্যখাতের সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
গবাদি পশু, দুগ্ধজাত ও পোল্ট্রিখাতে পদ্মা সেতুর প্রভাব অত্যন্ত ইতিবাচক। সেতু চালু হওয়ায় দুগ্ধ ও মাংসশিল্প বিকশিত হবে। গরু মোটাতাজাকরণ কর্মসূচী দ্রুত এগিয়ে যাবে। দুগ্ধখামার গড়ে উঠবে। মাদারীপুরের দুগ্ধউৎপাদন কেন্দ্রের পরিধি শরীয়তপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। পোল্ট্রি শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটবে। জেলায় একসময় গোখাদ্যের অভাবে গরু পালন কমে গিয়েছিল। বর্তমানে উন্নতজাতের ঘাস আবাদ করে ছোটো ছোটো খামার গড়ে উঠেছে। পদ্মা সেতুর ফলে বড়ো খামার গড়ে ওঠার পম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দুগ্ধপ্রক্রিয়াজাত শিল্প ও সহজ পরিবহনব্যবস্থাই এর মূল কারণ। শরীয়তপুরের প্রায় চারপাশেই নদী। ফলে এর বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে গরুর উন্মুক্ত বিচরণক্ষেত্র গড়ে উঠতে পারে সহজেই। সহজ পরিবহণব্যবস্থার কারণে দানাদার খাদ্যের মূল্য-হ্রাস পাবে। খামারিরা প্রাণি-পাখি প্রতিপালনে আগ্রহী হবে। দুধ ও মাংসপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিকাশ ঘটবে। এতে বৃদ্ধিপাবে খেটেখাওয়া মানুষের কর্মসংস্থান। পরিবহনখরচ কমাতে শরীয়তপুরের অধিকাংশ পশু ব্যবসায়ী ট্রলারে পশু নিয়ে রাজধানীতে যেতেন। দুলাল খান চিকন্দী ইউনিয়নের আবুরা গ্রামের বাসিন্দা। দুলাল কৃষি কাজের পাশাপাশি দু’চারটা গরু পালন করতো। কুরবানীর ঈদ সামনে রেখে সে মোটাতাজা গরু নিয়ে ট্রলারে ঢাকা যেত। বছরকয়েক আগে ঢাকা যাওয়ার পথে মুন্সীগঞ্জের তালতলা খালে গরুর ট্রলার ডুবে যায়। তার সাথে থাকা টাকা-পয়সা ও জামা-কাপড় পাড়ে রেখে লাফিয়ে পড়েন গরু বাঁচাতে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পানি খেতে খেতে তার গরু মারা যায়। খালেরপাড়ে রাখা টাকা-পয়সা, জামা-কাপড় নিয়ে যায় স্থানীয় ছেচরা চোর! দুলাল আম-ছালা দু’টোই একসাথে হারান। সদর উপজেলার দক্ষিণ গোয়ালদী গ্রামের ইলিয়াছ ফকির পাঁচ-সাত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবাসজীবন কাটিয়ে, দেশে এসে ছোটো আকারে দুগ্ধখামার করে। খাবার সংগ্রহ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, দুধ বাজারে নেয়া—সব একাই করে সে। পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে ইলিয়াস স্বপ্ন দেখছেন শরীয়তপুরে দুগ্ধপ্রক্রিয়াজাত শিল্প হবে। কোম্পানির গাড়ি এসে খামার থেকে দুধ নিয়ে যাবে এবং দামও ভালো পাবে। ফলে তার সময় বেঁচে যাবে। তাই সে খামারটি সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পৌর এলাকার স্বর্ণঘোষ গ্রামের বাসিন্দা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত, অত্র অঞ্চলের পোল্ট্রি শিল্পের পথপ্রদর্শক ও প্রাণিচিকিৎসক এফএম রুহুল আমিন বলেন, ‘পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে পোল্ট্রি খাদ্যের দাম কমবে এবং এই শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে বেকারত্ব দূর হবে।’
পদ্মা সেতু শরীয়তপুরের শিক্ষাখাতে কী প্রভাব ফেলবে এ নিয়ে খুববেশি খবর চোখে পড়েনি। তবে আমার বিশ্বাস পদ্মা সেতু যোগাযোগ, পর্যটন ও কৃষিখাতের মতোই জেলায় শিক্ষাখাতের ব্যাপক পরিবর্তন আনবে। বিশেষ করে নারীদের উচ্চশিক্ষায়। জেলার কেন্দ্রে দুইটি সরকারি কলেজ ছাড়াও প্রতিটি উপজেলায় রয়েছে একটি করে সরকারি কলেজ। এ ছাড়াও অসংখ্য বেসরকারি কলেজ রয়েছে এই জেলায়। ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকার বিভিন্ন কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যায়। পদ্মা সেতুর ফলে সেই প্রবণতা বৃদ্ধিপাবে তা শুধু নয়, ভালোমানের শিক্ষকরা জেলার কলেজগুলোতে শিক্ষকতা করতে আগ্রহী হবেন। আগে ঢাকায় পড়তে হলে ছাত্রছাত্রীদের পদ্মা পাড়ি দিয়ে যেত হতো। অনেক সময় লঞ্চ, ট্রলার কিংবা স্পিডবোর্ড ডুবে পুরো পরিবারের স্বপ্ন শেষ হয়ে যেতো। খরস্রোতা পদ্মায় প্রিয়জন হারানো সেই স্মৃতি বয়ে বেড়াতো যুগযুগ। সরকারি শামসুর রহমান কলেজের অধ্যক্ষ মো: ফজলুল হক বলেন—‘যোগাযোগব্যবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে আমাদের কলেজে দূরের শিক্ষকরা থাকতে চাইতেন না। পদ্মা সেতু উদ্বোধন ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে সেই সমস্যার সমাধান হয়েছে।’ শরীয়তপুরে শিক্ষাপ্রসারের ব্যাপক সম্ভাবনার আসল কারণটা এবার দেখি। ভেদরগঞ্জের মধুপুরে সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশে কোলাহলমুক্ত দেশের একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মনোয়ারা সিকদার মেডিকেল কলেজ। এছাড়াও শরীয়তপুর জেলায় শেখ হাসিনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হওয়ার অপেক্ষায়। বিভাগীয় শহর ছাড়া অন্যকোনো জেলায় একসাথে এমন ত্রয়ীর সমন্বয়: মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আছে বলে আমার জানা নেই। প্রতিষ্ঠান তিনটি শুধু এ অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মানুষের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করবে না, সমগ্রদেশের ছাত্রছাত্রীদের অধ্যায়নের সুযোগ তৈরি করে দিবে। এছাড়াও মজিদ জরিনা ফাউন্ডেশন স্কুল এন্ড কলেজ ও ক্যান্টনম্যান্ট স্কুল এন্ড কলেজ শরীয়তপুর জেলার শিক্ষাখাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।
প্রতিনিয়ত ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি ক্লিনিক বাড়ছে শরীয়তপুরে। তবুও ভালোমানের চিকিৎসাসেবার জন্য শরীয়তপুরবাসির ঢাকামুখী হতে হয়। অনেকসময় ফেরির অপেক্ষায় থেকে মুমূর্ষু রোগীর মৃত্যু হতো ঘাটেই। যাতায়াতের ঝাক্কি-ঝামেলা ও ফেরি পারাপারে দীর্ঘসময় অপেক্ষার কারণে অনেকে শরীয়তপুরেই ভরসা করতো। আগে ভোর ছয়টায় রওনা করে ডাক্তার দেখিয়ে ঢাকা থেকে ফিরতে রাত দশ-এগারোটা বেজে যেত। বর্তমানে সকালে গিয়ে সন্ধায়ই চলে আসা যায়। এখন স্থানীয় হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো উন্নত সেবা দিতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে পারবে। নিউ পপুলার হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য খন্দকার শহীদুল ইসলাম (বাবু) বলেন—‘আগে খারাপ যোগাযোগব্যবস্থা ও ফেরির কারণে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শরীয়তপুরে আসতে চাইতেন না। পদ্মা সেতুর ফলে সেই সমস্যা মিটে গেছে। তাই বর্তমানে আমাদের হাসপাতালে বিভিন্ন দিনে একাধিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ব্যবস্থ করতে পারছি।’ ঠিক এভাবেই ঢাকামুখীতা রোধে ভালো সার্ভিস দিয়ে স্থানীয় হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। শরীয়তপুরের জনগণ কম খরচে ভালোমানের সেবা পাবে। এক্ষেত্রে ‘মনোয়ারা সিকদার মেডিকেল কলেজ’ ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। শরীয়তপুর সদরের চিতলিয়া ইউনিয়নের পশ্চিমপাড় গ্রামের গৃহিণী সুমি আক্তারের ০৬ মাসের ছেলের থেলাসেমিয়া রোগ ধরা পড়ে। সুমিকে ছেলে নিয়ে রক্ত দেয়ার জন্য ২১ থেকে ২৫ দিন পর ঢাকা যেতে হতো। ঢাকার ডাক্তার পরামর্শ দেন মধুপুরে অবস্থিত মনোয়ারা সিকদার মেডিকেল কলেজে কর্মরত তার প্রাক্তন এক সহকর্মীর সাথে যোগাযোগ করার জন্য। বর্তমানে ওখান থেকেই ছেলেকে রক্ত দেন সুমি। গৃহিণী সুমি জানতেনই না শরীয়তপুরে মেডিকেল কলেজ রয়েছে। পদ্মা সেতুর ফলে দূরদূরান্ত থেকে ছাত্রছাত্রীরা আসবে পড়াশুনার জন্য, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আসবেন ক্লাস নিতে। ফলে শরীয়তপুর নয় সারাদেশে ছড়িয়ে যাবে শরীয়তপুর জেলার উন্নত স্বাস্থ্যসেবার সুনাম। এমনটাই আশা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের।
শিল্পবিপ্লব পরবর্তী বিশ্বে শিল্পখাতে যারা যত উন্নত, অর্থনৈতিক ভাবে তারা তত সমৃদ্ধ। তাই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য শিল্প-কারখানা স্থাপনের যেমনি বিকল্প নেই, তেমনি শিল্প-কারখানা স্থাপনে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থারও কোন বিকল্প নেই। পদ্মা সেতুর শিল্প-কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনাকে জেলায় শতগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে শরীয়তপুরে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার পরিকল্পনা করছে জেলা প্রশাসন। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে যারা শিল্প-কারখানা করতে চান, তাদের সব ধরনের সহায়তা করতেও প্রস্তুত তারা। শরীয়তপুরের অসংখ্য লোক ইতালি, স্পেনসহ মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করেন। সেতু হওয়ার ফলে তারা দেশে ফিরে বিদেশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শিল্প-কারখানা করতে চাচ্ছেন। এছাড়াও জেলার অনেক শিল্পপতির দেশের বিভিন্ন স্থানে শিল্প-কারখানা রয়েছে। অনেকে সেসব শিল্পকারখানা শরীয়তপুরে স্থানান্তরসহ নতুন কারখানা গড়ে তুলতে চাচ্ছেন। ইতিমধ্যে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। দ্রুত গতিতে চলছে ‘শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি’র কাজ। তাঁতপল্লিসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা ঘিরে আগামী কয়েকবছরের মধ্যে শরীয়তপুরে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির আশা প্রকাশ করা হচ্ছে।
শরীয়তপুর থেকে ঢাকার দূরত্ব ৭৭ কিলোমিটার (প্রায়)। ঢাকার সাথে দক্ষিণের অন্যান্য জেলার দূরত্ব পদ্মা সেতুর ফলে কমলেও শরীয়তপুরের দূরত্ব কমেনি। তবে শরীয়তপুর জেলার জন্য উন্মুক্ত করেছে অফুরান সম্ভাবনা। সেতু স্থাপনের ফলে শরীয়তপুরের আবাসনখাতে ব্যাপক সম্ভাবনা জেগেছে। শরীয়তপুর-ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় ব্যবসায়ীসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা শরীয়তপুর থাকতে আগ্রহী ছিলেন না। বর্তমানে এমনটি আর হবে না। সেতু উদ্বোধনের কিছুদিন পর একটি পরিবারকে দেখা যায় ট্রাকে করে মালামাল নিয়ে শরীয়তপুর আসতে। পরিবার প্রধান বলেন, ‘এখন আর তারা ঢাকায় থাকবেন না। শরীয়তপুর থেকেই অফিস করবেন।’ আসলে ঢাকায় থাকাখাওয়াসহ আনুসাঙ্গিক অন্যান্য যে খরচ তাতে গ্রামের বাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকা অনেক ভালো বলেই তিনি মনে করেন। তাই নিজ এলাকায় স্থায়ী বসবাসের ইচ্ছায় তার মতো অনেকেই নির্মাণ করছেন পাকা বাড়ি। বর্তমানে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, শিক্ষক ও ডাক্তারগণ আর তদবিরের মাধ্যমে শরীয়তপুর থেকে অন্যত্র বদলী হবেন না। তাদের বসবাসের জন্য উন্নত সুযোগসুবিধা সংবলিত অট্টালিকা নির্মাণের ফলে নির্মাণসামগ্রী বিক্রি অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিসমিল্লাহ টাইলসের স্বত্বাধিকারী মোঃ হোসেন বেপারী জানান, ‘বর্তমানে মানুষ প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পাকা বাড়ি নির্মাণে টাইলস ব্যবহার করছেন। আগে দোকান ভাড়া তুলতেই হিমশিম খেতে হতো। এখন পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে।’ ইট-বালু ব্যবসায়ী ইব্রাহিম খাঁন জানান, ‘পাকা স্থাপনা ও ইমারত নির্মাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আগে তার যে ইট-বালু বিক্রি হতো এখন তা দ্বিগুণেরও বেশি।’ জেলার রড-সিমেন্ট ব্যবসার পরিমাণও বর্তমানে অনেক ভালো।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে এ
পর্যন্ত শরীয়তপুরবাসির যাপিত জীবনে সেতু সরাসরি কী প্রভাব ফেলছে এবার তা একটু
খুঁজে দেখি। শরীয়তপুর সদরের স্বর্ণঘোষ গ্রামের ফয়সাল খান সিঙ্গাপুর থেকে ছুটি
কাটাতে বাড়ি এসেছেন। প্রতিবার বাড়ি আসার সময় শুধুমাত্র বড়ভাই এয়ারপোর্টে এগিয়ে
আনতে যেতেন। পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে এবার বাড়ির লোকজনসহ আত্মীয়-স্বজনও মাইক্রোবাস
ভাড়াকরে এগিয়ে আনতে যায় ফয়সালকে। বর্তমানে দারাজ, রকমারিসহ অন্যান্য অনলাইন
প্লাটর্ফমে পণ্য কেনার জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও কুরিয়ারের মাধ্যমে
ছোট আকারের পণ্য পাঠাচ্ছেন অনেকেই। বিশেষ করে করোনা মহামারির সময় থেকে অনলাইন
প্লাটর্ফম ও কুরিয়ার বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আগে অনলাইনে পণ্য অর্ডার করলে বা
কুরিয়ারে পাঠালে ৩/৪ দিন লেগে যেত। বর্তমানে দিনে দিনে বা পরের দিনই পেয়ে যাচ্ছি।
গত ২৪ আগষ্ট ‘জাতীয় সাহিত্য ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত বঙ্গবন্ধুর ৪৭ তম শাহাদাৎ বার্ষিকী
উপলক্ষ্যে আলোচনা ও কবিতা পাঠের আয়োজন করা হয় কলেজ রোড ‘বইঘরে’। আলোচনার প্রধান
অতিথি শিশুসাহিত্যিক ও কবি ফারুক নওয়াজ জানান, ‘ঢাকা থেকে রওনা করে মাত্র। দুই
ঘন্টায় অনুষ্ঠানে পৌঁছে গেছেন।’ এছাড়াও গত ১২ ও ১৩ জানুয়ারি বাংলা একাডেমির সমন্বয়ে
এবং জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত ‘শরীয়তপুর জেলা সাহিত্য মেলা ২০২২’
অনুষ্ঠানে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী পরিচালক গাজী রাকায়েত বলেন ‘পদ্মা সেতুর
ফলে শিল্প-সংস্কৃতির বিপ্লব ঘটবে শরীয়তপুরে।’ কবি, সম্পাদক ও লোকজ গবেষক
শ্যামসুন্দর দেবনাথ জানান—‘বর্তমানে
শরীয়তপুরের কবি সাহিত্যিকেরা দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা করে চাইলেই ঢাকার সাহিত্য
অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে, রাতের খাবার খেতে পারবে শরীয়তপুর এসে।’ সম্মেলিত
সাংস্কৃতিক জোট শরীয়তপুর জেলার সভাপতি এ্যাড: মুরাদ হোসেন মুন্সি বলেন ‘বর্তমানে
সহজেই চলচ্চিত্র ও নাটক পাড়ার পরিচালক, কলাকুশলি, নায়ক-নায়িকারা পদ্মা সেতুর ওপর
দিয়ে চলে আসবেন শরীয়তপুরের প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে শুটিং করার জন্য। ফলে ঢাকার
সাথে শরীয়তপুরের সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধি পাবে।’ মো: সাইফুল হক, পুলিশ সুপার,
শরীয়তপুর বলেন—‘পদ্মা সেতুর কারণে
শরীয়তপুর জেলা পুলিশ বিভাগের সেতু এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ভিভিআইপি, ভিআইপিসহ
অন্যান্য যাত্রীদের সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানের জন্য কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে।’
কথা হয় রতন মাঝির সাথে। যিনি বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের পণ্য তার ট্রলারে করে ঢাকা ও
নারায়ণগঞ্জ থেকে শরীয়তপুর আনেন। এছাড়াও অনেক লোক লঞ্চ, ট্রলার ও স্পিডবোর্ডে
যাত্রী পারাপারে যুক্ত ছিলেন। অনেকের মাঝির ঘাটে ছিল হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসা
প্রতিষ্ঠিান। তাদের সকলেরই সেতুর ফলে পথেবসার উপক্রম। আমরা করোনা মহামারিতে
অনেককেই চাকরি হারিয়ে পথে বসতে দেখেছি। আবার দেখেছি শুধু মাস্ক বিক্রি করে কেউ কেউ
লাখ টাকা রোজগার করেছে। সময়ের সাথে যারা তালমিলিয়ে চলতে পারে তারা কখনও হারে না।
আমার আশা রতন মাঝিরাসহ মাঝিরঘাটের মাঝি ও ব্যবসায়ীরা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে
তালমিলিয়ে পদ্মা সেতুর ফলে শরীয়তপুরে কর্মসংস্থানের যে ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি
হয়েছে। নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা সেই সম্ভাবনা কাজে লাগাবে—নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরির মাধ্যমে। জেলা ঘোষণার ৪০ বছরেও
শিক্ষা, চিকিৎসা ও যোগাযোগব্যবস্থায় পাশের জেলাগুলোর তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে
শরীয়তপুর। অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিকতার ছোঁয়া বঞ্চিত শরীয়তপুরকে দেশের ৬৪ নম্বর জেলা
হিসেবেই বিবেচনা করা হতো এতদিন। বর্তমানে জেলায় জমির দাম স্থানভেদে ১০ গুণ পর্যন্ত
বৃদ্ধি পেয়েছে। পদ্মা সেতুর বদৌলতে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার মধ্যে অন্যতম
সম্ভাবনাময় জেলা হচ্ছে শরীয়তপুর। সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবরূপ দিতে শরীয়তপুরের
অভ্যন্তরীণ সড়ক ও পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কের উন্নতির বিকল্প নেই। আমরা জানি ২০২০
সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ১ হাজার ৭ শত কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০ কি.মি. দৈর্ঘ্যের চারলেন সড়ক
প্রশস্তকরণের প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। কিন্তু আজও দুইলেনের কাজ সম্পন্ন হয়নি।
অপর দিকে মনোহর বাজার থেকে আলুরবাজার পর্যন্ত সড়কের একই দশা। পদ্মা সেতু
ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ইউরো-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক সিস্টেমের একটি
অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এশিয়ান হাইওয়ে ও ইউরো-এশিয়ান রেলওয়ে
নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। উক্ত হাইওয়ে ও রেললাইনের অংশ শরীয়তপুরের
ওপর দিয়েই যাবে। তারপরও শরীয়তপুরবাসিকে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে এখনো ফোরলেন সড়কের
অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। তবে ফোরলেন সড়কটি যদি শরীয়তপুর শহরকে বাইপাস করে অথবা শহরের
অংশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করা যেত, তবে সরকারি বেসরকারি অনেক স্থাপনা রক্ষার
পাশাপাশি সরকারের পুনর্বাসন ব্যয় অনেক কমে যেত। অপর দিকে চাঁদপুর হয়ে চট্টগ্রামের
সাথে যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে মেঘনা সেতুরও সমীক্ষা চলছে। সেতুটি হলে চট্টগ্রাম
বন্দর, মংলা বন্দর, ভোমরা ও বেনাপোল বন্দরের সংযোগ স্থাপিত হবে শরীয়তপুরের ওপর
দিয়ে। পদ্মা সেতুর ফলে ইতিমধ্যে শরীয়তপুরের যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন শুরু
হয়েছে। কয়েকবছরের মধ্যে অপেক্ষার পালা শেষ করে শরীয়তপুর জেলা হবে উন্নত, আধুনিক ও
স্বনির্ভর জেলা। শরীয়তপুর বাংলাদেশের উন্নত জনপদ হিসেবেই শুধু বিবেচিত হবে না,
শরীয়তপুর হবে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির দশটি জেলার মধ্যে একটি। ‘সোনালি সেতুর
শ্যামলভূমি’ খ্যাত শরীয়তপুর জেলায় পদ্মা সেতুর কারণে সোনা ফলবে—এই প্রত্যাশা আমাদের।
অনেক সুন্দর পর্যালোচনা
উত্তরমুছুন