মুসলিম উম্মার ঈদ উৎসব ।। চঞ্চল মেহমুদ কাশেম

মুসলিম উম্মার ঈদ উৎসব

চঞ্চল মেহমুদ কাশেম



ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। এই আনন্দ যুগে যুগে, জাতিতে জাতিতে, তাদের স্মরণীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে, ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদ উদযাপন করে আসছেন। বিশেষ করে আহলে কেতাবি যারা, অর্থাৎ ইহুদি, ঈসায়ী এবং মুসলমান এই তিন ধর্মের লোকেরাই আহলে কেতাব বা আসমানি কেতাবের অনুসারী বলে গণ্য। আর তাদের কিছু কিছু ধর্মীয় উৎসবকে তারা ঈদপর্ব হিসেবে প্রতি বছর উদযাপন করে থাকেন। মুসলমানদের রয়েছে প্রধানত বছরে দু’টি ঈদ। একটি “ঈদুল ফিতর” এবং আরেকটি “ঈদুল আজহা।” ঈসায়ীদেরও রয়েছে মূলত দু’টি ঈদ। তবে তারা, বিশেষ করে এদেশের ঈসায়ীরা যেহেতু বাংলা ভাষাভাষী, সেহেতু বাংলা ভাষায়ই তাদের পর্বগুলোকে অবহিত করে থাকেন। তাঁদের ধর্মীয় প্রধানত দু’টি পর্বের মধ্যে একটি হচ্ছে হজরত ঈসা মসীহর জন্মদিন “শুভ বড়দিন” যাকে আরবিতে বলা হয় ঈদে উলিদুল ইয়ামুল ঈসা। আরেকটি তাঁর মৃত্যু থেকে পুনরুত্থানের দিন “শুভ পুনরুত্থান দিবস।”

ইহুদিদের রয়েছে অনেক পর্ব বা ঈদউৎসব। আহলে কিতাবিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঈদ উদযাপন করে থাকেন ইহুদি সম্প্রদায়। অবশ্য কিতাবিদের মধ্যে তারাই প্রথম লা-শরিক আল্লাহ বা একেশ্বরবাদে ঈমান আনার দাবিদার। কিতাবগুলোই এই সাক্ষ্য বহন করে। ইহুদিরা তাওরাত, জবুর এবং নবিদের কিতাগুলো বিশ্বাস ও অনুসরণ করেন। তারা ইঞ্জিল ও কোরান শরিফে বিশ্বাস করেন না। তবে ঈদ (উৎসব পর্ব), হজ (জেরুশামে প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে সম্মিলিত হওয়া), জাকাত (দান), রোজা (উপবাস ব্রত), ত্বকচ্ছেদ, মাবুদের এবাদত, এসমস্ত ধারণাগুলো মূলত ইহুদিদের কাছ থেকেই এসেছে। ইহুদিদের অনেক ঈদের মধ্যে প্রধান প্রধান কয়েকটি হলো। ঈদুল ফেসাখ বা উদ্ধার ঈদ, বাইতুল মোকাদ্দস বা খোদার ঘর প্রতিষ্ঠার ঈদ, কুড়ে ঘরের ঈদ, খামিহীন রুটির ঈদ, পঞ্চাশপ্তমীর ঈদ, ঢাকার ঈদ, ফসল কাটার ঈদ বা সাত সপ্তাহের ঈদ এবং শিভাধ্বনির ঈদ।

যেহেতু এই স্বল্প পরিসরে সকল সম্প্রদায়ের ঈদপর্বগুলো নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়, তাই আসুন, আমরা এখানে শুধু আমাদের দেশে প্রচলিত এবং উদযাপিত মুসলিম জাতির ঈদুল ফিতর ও আযহা নিয়ে আজ আলোকপাত করা যাক।

 

ঈদুল ফিতর


মুসলিম জাতির শ্রেষ্ঠ পর্ব হচ্ছে ঈদুল ফিতর। শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে রমজান মাসের রোজা ভঙ্গের উৎসব উদযাপন হচ্ছে ঈদুল ফিতর। প্রতি বছর আরবি রমজান মাসের ৩০ বা ২৯ দিনের রোজা পালনের শেষে অর্থাৎ ১লা শাওয়াল হতে তিনদিন ব্যাপী এই ঈদঅনুষ্ঠান পালন করা হয়। ইসলামী পরিভাষায় ঈদের আগের রাতটিকে জাজা (অর্থাৎ পুরস্কারের রজনী) এবং চলতি ভাষায় চাঁদরাত বলা হয়। মদিনার বদর প্রান্তরে মুসলিমদের সঙ্গে কতিপয় কোরাইশদের একটি যুদ্ধসংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে সামান্য সংখ্যক সৈন্য বাহিনী নিয়ে মুসলিমরা বিজয় অর্জন করেন। দিনটি ছিল ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই মার্চ। গুরুত্বপূর্ণ এই যুদ্ধ বিজয়ের স্মরণার্থে সমগ্র মুসলিম জাতি দ্বিতীয় হিজরি থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে ঈদুল ফিতর উদযাপন করে থাকেন।


এই ঈদে সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা গরিব-দুঃখীদের মধ্যে নির্ধারিত হারে গম, আটা বা তার বদলে নগদ টাকা-কড়ি দান করে থাকেন। এই দানকে ফিতরা বলা হয়। এজন্যই ঈদুল ফিতর। ঈদের দিনে ফিন্নি-পায়েশ, শেমাই ইত্যাদি রকমারি খাবার দিয়ে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের আপ্যায়ন করা হয়। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন পোশাক পরা হয়। নানান রকম উপহার সামগ্রী প্রিয়জন ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উপহার দেওয়া হয়। পত্রপত্রিকাগুলো ঈদ উপলক্ষে, ঈদসংখ্যা নামে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে থাকে।


সাহ্যিানুরাগীরা অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে প্রকাশ করেন বিশেষ সাহিত্য সাময়িকী। ঈদগাহে ধনী-গরিব, বাদশাহ ফকির, ছোট-বড় সবাই এককাতারে জমায়েত হন। সেখানে তারা ইমামের পিছনে, ৬ তকবিরের সঙ্গে ২ রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করেন। ক্ষণিকের জন্য হলেও এই দিনে তারা সকল ভেদাভেদ ভুলে যান। প্রকাশ পায় ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি।


ঈদুল আজহা


জিলহজ চন্দ্র মাসের ১০ তারিখে আল্লাহর রাহে পশু কোরবানি বা ত্যাগের নিদর্শনকে বলা হয় “ঈদুল আজহা” বা ঈসুজ্জোহা কিংবা কোরবানি ঈদ। ধর্মীয় ইতিহাস থেকে জানা যায়, হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালনের জন্য তাঁর নিজ পুত্রকে কোরবানি দিতে গিয়েছিলেন। মহান আল্লাহতা’লা ইব্রাহিমের ঈমান ও আনুগত্যে খুশি হয়ে, কোরবানির জন্য তাঁর ছেলের বদলে একটি মেষ (কোনো কোনো তফসিরকারক বলেন দুম্বা) যুগিয়ে দিয়েছিলেন। পাককালামে কোরবানির সর্বজন- বিদিত উদাহরণ সন্দেহাতীতভাবে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর জীবনে ঘটেছিল। ত্যাগের পরীক্ষা হিসেবে, আল্লাহ হজরত ইব্রাহিম (আ.) কে তাঁর প্রিয়তম পুত্রকে কোরবানি দিতে আদেশ দিয়েছিলেন। আল্লাহর আদেশে তিনি ছেলের উপর ছুরি উঠিয়েছেন, ঠিক সে সময় আল্লাহতা’লা তাঁর ছেলের পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি করতে আদেশ দিলেন এবং আল্লাহ স্বয়ং দুম্বাটিকে যোগাড় করে দিলেন। ইব্রানি ভাষায় বলা হয় “ইহোবা যিরি” অর্থাৎ আল্লাহ যোগানদাতা। এইভাবেই হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর দেয়া আদেশ পালন করেছিলেন। আর মুসলমানেরা বলেন- ইব্রাহিমের বাঁদি দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরার গর্ভের সন্তান ইসমাইলকে কোরবানি করতে নেয়া হয়েছিল। তবে সন্তান যে-ই হয়ে থাকুক, মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহতালার বাধ্য থাকা, তাঁর আহবানে সাড়া দেওয়া। আর সেই ঈমানি পরীক্ষায় হজরত ইব্রাহিম উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। হজরত ইব্রাহিমকে ইহুদি, ঈসায়ী এবং মুসলমান এই তিন ধর্মীয় সম্প্রদায়ই জাতিগতভাবে তাদের আদিপিতা বলে গণ্য করে থাকেন। তাছাড়া তাঁর নাম প্রথম ছিল “ইব্রাম’। ইব্রাম মানে ‘মহান পিতা’। আল্লাহতা’লা হজরত মুসা (আ.) কে কোরবানির বিশেষ গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। শরিয়ত মানুষের পাপকে প্রকাশ করে দেয়। আর কোরবানি আল্লাহর রহমত পাওয়ার পথকে সুগম করে দেয়। কোরবানি শব্দটি সাধারণত ত্যাগ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে আরবি ‘কুরবান’ হতে কোরবানি শব্দটি এসেছে। সাহিত্যের ভাষায় এর অর্থ দাঁড়ায় “যার মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হয়”। কোরবানি অনুশীলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, মানব জাতিকে আল্লাহর রহমত ও অনুকম্পা প্রদানের সিঁড়ি বা ব্যবধান অতিক্রমের সেতু। পাপের দ্বারা আল্লাহর সঙ্গে মানষের সম্পর্ক যেটুকু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, কোরবানি তা পুনরুদ্ধারের কাজ করে। আল্লাহতা’লা মুসা (আ.) কে দুই প্রকারের কোরবানি প্রচলন করার আদেশ দিয়েছিলেন। প্রথমটি হচ্ছে একটি শিশুর জন্মের সময় একটি বালকের ৪০ দিন বয়সে এবং বালিকার ৮০ দিন বয়সে, তার পরিবারকে একটি ভেড়া অথবা একটি ঘুঘু, পাপের জন্য কোরবানি করতে হতো। কোরবানির পশুকে জবাই করা হতো এবং ঐ রক্ত মাটিতে পতিত হতো। যখন কোনো মানুষ তার পাপকে মেনে নিত এবং অনুতপ্ত হতো, তখন আল্লাহ পাপী ব্যক্তির জীবনের পরিবর্তে নিরীহ পশু কোরবানির ত্যাগকে স্বীকার করে নিতেন। এভাবে পাপের জন্য শরিয়ত ভঙ্গকারীর মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে নিরীহ পশু কোরবানির ত্যাগকে আল্লাহ পাপের জরিমানা বা কাফফারা হিসেবে কবুল করে নিয়েছেন। পশু কোরবানি অন্তরের পাশবিকতা ত্যাগেরই একটি প্রতীক।


তারা প্রতিবছর আরবি জিলহজ মাসের ১০ তারিখে এই ঈদ অনুষ্ঠান শুরু করেন এবং পরবর্তী তিনদিন ধরে চলতে থাকে এই উৎসব। সামর্থ্যবানদের জন্য এই ঈদে, আরব দেশের মক্কা শরিফে গিয়ে, হজব্রত পালন করা ফরজ এবাদত। মক্কায় হজ অনুষ্ঠানের পরদিন থেকে সারা বিশ্বে এই ঈদ অনুষ্ঠান পালন শুরু হয়। কোনো কোনো দেশে বা বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলের লোকেরা মক্কায় হজ অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গেই ঈদ পালন শুরু করে দেন। ঈদুল আজহায় যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া, উট, দুম্বা ইত্যাদি নিখুঁত পশু আল্লাহর রাহে কোরবানি করা হয়। কোরবানির গোশত আত্মীয়-স্বজন ও গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ কারা হয় যেন সকলেই ঈদ উৎসবের ভাগীদার হতে পারেন। ঈদুল ফিতরের মতো এই ঈদের ঈদগাহ অথবা মসজিদে সকলে এককাতারে দাঁড়িয়ে, ঈদের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করেন। আমাদের দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আমাদের দেশেও মুসলিম সম্প্রদায় তাদের ঈদউৎসবগুলো জাঁকজমকের সঙ্গে এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যতায় এবাদতের মাধ্যমে ঈদপর্বগুলো পালন করে থাকেন। এই উৎসবগুলো পালনের মাধ্যমে, সকলের মধ্যে ফিরে আসবে ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, মহব্বত ও সহমর্মিতা। তাইতো আমাদের সর্বজনীন শ্লোগান হচ্ছে “ধর্ম যার যার, উৎসব সবা”।


লেখক: কবি, সাহিত্য সংগঠক ও গ্রন্থালোচক, নারায়নগঞ্জ।


বি: দ্র: লেখাটি কীর্তিনাশার কাব্য (সাহিত্যের ছোট কাগজ) ঈদ সংখ্যা ২০১৯-এ প্রকাশিত হয়।

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন