কবি : ইয়াসিন আযীয
প্রকাশনি : অনন্যা
প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশ : একুশের বই মেলা ২০২৪
দহনকাল সময়ের
প্রতিচ্ছবি
শ্যামসুন্দর দেবনাথ
দেশপ্রেম, নৈসর্গিক ব্যঞ্জনা, সামাজিক অনিয়ম, অনাচার-অবিচার, অধিকার বঞ্চিত মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, দীর্ঘনিঃশ্বাস, পল্লীপ্রেম, মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ, প্রাকৃতিক সুশৃংখল সৌন্দর্যের সমাবেশ মানুষ কর্তৃক নিধনে কবির আত্মিকপরিবেদনা; দেশের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি, পাশাপাশি নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির আশা-আকাঙ্খার অপূর্ণতার প্রতিফলনে কবির মনোব্যথা; পারিপার্শ্বিক জীবনমানের নানাবিধ অসংগতিতে মানবপ্রেমী কবির বিবেকবোধে দ্রোহচিত্র তাঁর বিভিন্ন কবিতায় চিত্রায়িত হয়েছে।
গ্রামীণ জীবনের
নদী-নালা-খাল-বিল-শস্যক্ষেত, দেশের মানুষের অন্ন-খাদ্যের যোগানদাতা কৃষক-চাষী,
মজুরদের জীবন-জীবিকার সঙ্গে উদার-উদ্ভাসিত মনোজাগতিক প্রসন্নতামথিত চিত্তবৃত্তিক
প্রেমঘনিষ্ঠতা কবির প্রথম প্রকাশিত ‘দহনকাল’ কাব্যটির পরতে পরতে বেজে ওঠেছে।
‘দহনকাল’ কাব্য গ্রন্থটি সদ্য
প্রকাশিত হলেও কবির কাব্য-সাহিত্য চর্চা যে পুরনো ঋদ্ধহস্তের, তা তাঁর শব্দচয়নে,
শব্দ সংস্থাপনে, বাক্য গঠনে, শাব্দিক অনুপ্রাসে ও কাব্যিক ব্যঞ্জনায় প্রস্ফুটিত।
গদ্যধারার কবিতার সমাবেশের মাঝে মাঝে কয়েকটি পদ্য-ছন্দের কবিতাও পাঠকমনোকাশে
উঁকি-ঝুঁকি মেরে দোলায়িত করবে নিশ্চয়ই। গদ্য-পদ্যের সমভিব্যাহার, শ্লীলতাপূর্ণ ও
মালাকরী শব্দবিন্যাসের মাধুর্যঝরা কাব্যরসে সমঝদার কবিতাপ্রেমী পাঠকের চিত্তাকাঙ্খার
যথার্থ খোরাক জোগায়ে পরিতৃপ্ত করবে নিঃসন্দেহে।
দহনকাল : কালের সিঁড়ি বেয়ে
ইব্রাহিম খলিল
বেশ কিছুদিন আগে
হাতে পেয়েছিলাম কবি ইয়াসিন আযীযের কাব্যগ্রন্থ ‘দহনকাল’। দেশের সংকটময় মুহূর্তের
কারণে বইটি পড়া হয়ে ওঠেনি। মূলত দুই মাস আগে কবি মেহেদী মিজান সম্পাদিত সাহিত্যের
ছোটকাগজ ‘কীর্তিনাশার কাব্য’র লেখক কপি সংগ্রহের জন্য শরীয়তপুর সদরে গিয়েছিলাম।
কবি ইয়াসিন আযীযের আমন্ত্রণে। কীর্তিনাশা কাব্যের তিনি নির্বাহী সম্পাদক। সেখান
থেকেই তার লেখা কাব্যগ্রন্থ দহনকাল পেয়েছি।
প্রচ্ছদশিল্পী
মোস্তাফিজ কারিগরের করা নান্দনিক প্রচ্ছদ দেখেই বইটি পড়ার প্রবল আগ্রহ যেন আরও
বেড়ে যায়। নানা জটিলতা কাটিয়ে কিছুদিন আগেই বইটিতে চোখ রাখার সুযোগ পাই। কবি
ইয়াসিন আযীযের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে এর আগেও আমি পরিচিত ছিলাম। ফেসবুকে যুক্ত থাকায়
তার লেখা বেশকিছু কবিতা আমার পড়ার সুযোগ হয়েছিল।
কবি ইয়াসিন আযীয
আমাদের শরীয়তপুরের কীর্তিনাশা নদীর ওপরে অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। তাছাড়া
শরীয়তপুরের অনেক কীর্তিমান লেখককে তিনি তুলে এনেছেন আমাদের মাঝে তার চমৎকার চমৎকার
প্রবন্ধের মাধ্যমে। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তার অবাধ বিচরণ থাকলেও কবিতায় যেন
তিনি অনন্য অসাধারণ এক প্রতিভা। তার ‘দহনকাল’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ে আমার কাছে অন্তত
তা-ই মনে হয়েছে।
কবিতার বই বলতেই
মানুষ প্রেম-ভালোবাসা মিশ্রিত এক আবেগের বহিঃপ্রকাশ ভেবে থাকেন। সেই প্রচলিত
ভাবধারাকে ভেঙে দিয়ে কবি ইয়াসিন আযীয তার কাব্যগ্রন্থটি সাজিয়েছেন ভিন্নভাবে
ভিন্নমাত্রায়। কবির বিপ্লবী হাত ধরে এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা এসেছে কালের সিঁড়ি
বেয়ে। অর্থাৎ সময়ের নানা ঘটনার মধ্যদিয়ে। বিশ্ব মহামারি করোনাকাল থেকে শুরু করে
সময়ে-অসময়ে আমাদের সমাজে ঘটে যাওয়া নানা সংকটের কথা নিয়ে। এই কাব্যগ্রন্থে
লিপিবদ্ধ কবিতাগুলো পড়লেই কাব্যগ্রন্থের না্মকরণের সার্থকতা খুব সহজেই খুঁজে পাবেন
প্রতিটি পাঠক।
তার রচিত কবিতাগুলো অবলীলায় বলে যায় মনুষ্যত্ব
এবং বোধের কথা। যেমন-
‘কড়াপড়া হাতে সন্তানের মুখে পুরি এক টুকরো রুটি
এইটুকুই সুখ, এইটুকুই সন্তুষ্টি
তবুও বিনাদোষে গালি দাও, করো প্রবঞ্চনা।
দাস অথবা ক্রীতদাস থেকে শ্রমিক হলাম
আফসোস, মানুষ হলাম না।’
(কবিতা : মানুষ হলাম না)
কখনো কবি তার নিজ জেলার বন্যা পরিস্থিতি তুলে
এনেছেন তার কাব্যের নান্দনিক দোলায়। শরীয়তপুরের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত কবিতাটি প্রমাণ
করে তার নিজ জেলার প্রতি গভীর মমত্ববোধ। যেমন-
‘আইতে আইতে পদ্মা নদী ভাইঙ্গা নিলো বাড়িঘর
মাতা গোঁজার ঠাঁইও গেলো নদীর পেটে একের পর...।
গেলো বছর জমি-জিরাত ভাইঙ্গা আছিলো বারো-আত দূরে
এই বছর আবোর নতুন কইরা ভাঙ্গন ধরছে শইরাতপুরে।’
(কবিতা : রাক্ষুসী পদ্মা)
সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে লিখতে লিখতে কবির কলম
কখনো হয়ে উঠেছে প্রচণ্ড আশাবাদী। সমস্ত প্রতিকূলতার অবসাদ কাটিয়ে কবি গাইতে চেয়েছেন
শিকল ভাঙার গান। ভেঙেচুরে সমাজকে নিজ হাতে গড়ে তোলার এক অবাধ আহ্বানও করেছেন
কবিতায়। যেমন-
‘আমাদের হা তেই বদলাতে হবে সব জরাজীর্ণতা
দেবদূত আসবে
না-সত্যের আমল নেই।
আমাদেরই ভাবতে হবে
জীর্ণ সমাজের-
ঘুণে ধরা সময়ের কথা;
লিখতে হবে সুকান্তের
বাকি কথন।
এই তরি বাইতে হবে,
বিদ্রোহী হয়ে গাইতে হবে
প্রেমহীন-দহনকালের
গান।
(কবিতা : দহকালের
গান)
কবি ইয়াসিন
আযীয এর বিপ্লবী কলম শৈরাচারী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধেও গর্জে উঠতে দ্বিধাবোধ করেনি কখনো।
দেশের যে কোন সংকটময় মুহুর্তে তিনি লিখে গেছেন সাহসিকতার সাথে। সত্য আর ন্যায়ের পথে
তার কলম ছিলো স্রোতস্বীনি নদীর মতোই গতিময় ও প্রবাহমান। তাইতো তিনি লিখেছেনঃ-
‘ক্ষমতার লোভে,ব্যাক্তি স্বার্থ চরিতার্থে যতোই
বাহাদুরি করি না কেন-একদিন
ঠিকই রিক্ত শুন্য হাতে পাড়ি দিতে হয় জীবন তরি।কারও
ক্ষমতা চিরস্থায়ী
নয়, ইতিহাস তাই বলে। তবুও চরম সুখানুভুতির মূহুর্তের
চেয়ে স্বল্পায়ু
মানব জীবনে,জানি না আমাদের কেন এতো নক্ষত্র হওয়ার
স্বাদ।’
(কবিতা : মানব
জিবন)
কবিতার বইটি
পড়তে পড়তে আপনার মনে যদি প্রশ্ন জাগে কবি ইয়াসিন আযীয কি সাম্প্রদায়িক কবি নাকী সাম্যবাদী
কবি,তবে এক বাক্যে উত্তর হলো তিনি আগাগোড়া আপাদমস্তক একজন সাম্যবাদী কবি।কবির এই সাম্যবাদিতা
তার রচিত কবিতা "ধর্মের পাচালি"তে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।যেখানে তিনি সকল ধর্মের
মানুষের জন্যই উদাত্ত চিত্ত্বে লিখেছেন।কবি ইয়াসিন আযীয ধর্মের মুখোশে যারা ধর্মকে
ব্যবহার করে নৃশংসতা চালায় তারা যে প্রকৃত ধার্মিক নয় ধর্ম বিদ্বেষী সেটা স্পষ্ট উচ্চারণ
করেছেন নির্দ্বিধায় ।তাইতো তিনি তার ধর্মের পাচালিতে লিখেছেনঃ-
‘মসজিদ মন্দির গির্জা প্যাগোডা-কেউ সহিংসতা চায়
না। সকলেই শান্তির
জন্য কথা বলে। ওখানে যারা যায় শান্তির জন্য যায়।
ওখানে গিয়ে সবাই
আত্মার জন্য শুদ্ধতা কামনা করে। ওখানে সবাই সৃষ্টিকর্তার
করুণা চায়।
মসজিদে গিয়ে কেউ জুতা চুরি করলে সেটা মুস্ললির দোষ
নয়; নামাজি
জুতা চুরি করে না চোরই চুরি করে।মন্দিরে গিয়ে যে
ভোগ করে খায়
সে প্রার্থনাকারী নয়-সে চোর।এমনিভাবে গির্জায় প্যাগোডায়....’
(কবিতা : ধর্মের
পাঁচালি)
বলতে গেলে এই
কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই একেকটি সময়ের বুলেট, যা কবির কলমের ডগা বেয়ে আশ্রয়
নিয়েছে দহনকালে। এযাবতকালে আমার পড়া কাব্যগ্রন্থের মধ্যে কবিতার বইটি সত্যি অনন্য।
পড়ে অসাধারণ লেগেছে। কবি ইয়াসিন আযীয বয়সে তরুণ হলেও তার লেখা প্রতিটি কবিতাই
পরিপক্ব ও দক্ষ হাতের সৃজন বলেই মনে হয়। আমি চমৎকার কাব্যগ্রন্থটির বহুল প্রচার
কামনা করছি।
কাব্যগ্রন্থ : দহনকাল
কবি : ইয়াসিন আযীয
প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশনী : অনন্যা
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২৪
মূল্য : ২৫০ টাকা।