কবি মির্জা হজরত সাইজী’র জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ।। ইয়াসিন আযীয

 

কবি মির্জা হজরত সাইজী’র জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

ইয়াসিন আযীয

 

 ছবি: জেলা আইনজীবী সমিতি শরীয়তপুরে গত বছর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে (লেখকের সৌজন্যে)


কবি মির্জা হজরত সাইজী। প্রকৃত নাম মির্জা হজরত আলী। বাবা: সাইজুদ্দিন মির্জা, মা: আছিয়া খাতুন। নামের শেষে ‘সাইজী’ বাবার অস্তিত্ব জিইয়ে রেখেছে। জন্ম: ১ জৈষ্ঠ্য ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ (১৫ মে ১৯৬০ খ্রি:) শরীয়তপুর জেলার জাজিরা থানার পদ্মার নিকটস্থ কান্তাইসার গ্রামে। উধাও আকাশের নিচে উড়ালদৌড় শেষে অথই নদীতে সাঁতার দিয়ে কেটেছে তাঁর শৈশব। তিনি একজন রাজনৈতিক কর্মী, বিজ্ঞ আইনজীবী এবং সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হলেও নেশায় একজন কবি। লিখছেন, লিখে চলছেন ছোটোবড়ো সকলের জন্য: ছড়া, কবিতা ও ছোটোগল্প। প্রকাশিত গ্রন্থ: এসো পাষাণ দ্রবীভূত হই (১৯৯৬), পাখির ডাকে দিলাম সাড়া (২০০৮), বালিকা রমণী হতে চায় (২০১৬), রাজনীতির কবি (২০২১), গাঁয়ের কোলে পরান দোলে (২০২১) মানিক ও কাকের গল্প (২০২৩)।

‘সুবহে সাদেকের আযানমাখা পবিত্র বাতাস, পাখির ডানায় ছিটকে যাওয়া রোদের হলুদ, আকাশের নীল, উদাসী আবেগ নিয়ে সুদূরে উড়ে যাওয়া মেঘ’ তাঁকে লিখতে বলে কবিতা! মানবতা যখন পিষ্ট হয় উদ্ভট সব অজুহাতে কিংবা যে শিশুটির জামা নেই, যে শিশুটির খেলা নেই, ঘুরতে যাওয়ার বেলা নেই, যে শিশুটি মেশিন ঘুরায়, আস্তাকুড়ে খাদ্য কুড়ায়, নির্যাতনে রা-ও নেই, যে শিশুটির মা-ও নেই... এমন শিশুদের দেখে কবির মন ককিয়ে ওঠে, বলে কবিতা লিখো। ‘তন্বী যুবতীর অকারণ খিল্ খিল্ হাসি, নরম মাটিতে হাঁটু ভেঙে বসেপড়া পোয়াতী আমন ধান, অঘ্রাণের নাড়া ক্ষেত, মিহিরাতের নরম ওঁস’ তাঁর কাছে কবিতা শিল্পের লোভনীয় কাঁচামাল। তিনি সোঁদামাটির গন্ধ শুঁকে শব্দে ছন্দে তুলে আনেন একেকটি পঙ্ক্তি। কবির শৈশব কেটেছে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি। যেখানে ছিল স্নিগ্ধ নদী, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠজুড়ে নববধূর মতো ঘোমটাখোলা ফসলের মুখ, ঘুঘুর বিষণ্ন বিলাপ, খেজুর গাছের গলায় রসের ধারা প্রভৃতি। স্নিগ্ধ নদী কখনো হয়ে ওঠে সর্বগ্রাসী ভেঙে নেয় বাড়ির আধেক উঠান, পড়ে থাকে নিঃসঙ্গ ভিটা। ফলে বালক কবি কিংবা তাঁর সমবয়সীরা হারায় শৈশব, কৈশোর। জীবন হা-হুতাশ করে এলোমেলো কবিতার মতো; হয়ে ওঠে অসমাপ্ত হাসি কান্না গান। শৈশবের সেই স্মৃতি এই জীবনে এসে উঠে আসে কবিতায়: ‘পুরনো বাড়িটির কথা মনে পড়ে খুব/ যে বাড়ির পুকুরটি নদীতে দিয়েছিল ডুব/ একটি লাল শাপলা কিশোরীর মতো হাত নেড়ে নেড়ে/ হাজার দিন সাঁতরিয়ে আমাকে গিয়েছিল ছেড়ে’এরকম অসংখ্য কবিতা। কৃষক তাঁর চোখে মেঠো কবি। ঢেঁকির পাড়ের শব্দ তাঁর কাছে উথাল বয়ান। তাঁর কবিতায় মোহনীয় উপমার প্রয়োগ যে কাউকেই মোহিত করে: ‘শুকনো মরিচের শুয়ে থাকা বিপ্লবী রঙ, এইমাত্র নিভেছে এমন উনুনের মতো হৃদয়, মাঠের নাড়া পোড়া তাপ গায়ে দূর পথে হেঁটে যায়, সন্ধ্যার আঁধার মুড়ি দিয়ে সব গল্প চলে গেছে এক ধাবমান রেলগাড়ি হয়ে, বকগলা সুবর্ণ কাস্তে দিয়ে আউশ ধান কাটে সোনার কৃষক, তখন চারপাশে আলোচালধোয়া পানির মতো আবছা আলো, মায়ের লেপা উঠান তখন নেমেছে ভরাট দুপুর/শরতের স্বচ্ছ আকাশ অনেকখানি উধাও উপুর’ এরকম অসংখ্য উপমায় বিন্যস্ত তাঁর কবিতার জমিন। কেওরের ফাঁকে, থোর কলা, বেগানা বাতাস, বিছন, ছেলান, ধুমছে, দবদবি, এক উয়াসে, তত্তরি, চিন্নালতা, বানাডুলির পাক, উশশি লতা, কোচটা, কোড়া’ ঘুলঘুলি, পিরহান ইত্যাদি পুরানো হতে চলা কিংবা শহরের মানুষের কাছে অপরিচিত শব্দরা বর্ষায় গুল্মলতার প্রাণ ফিরে পাওয়ার মতো তাঁর হাতে যেন প্রাণ পায়। পোকায় খাওয়া পাকিস্তান, মুজিব মুক্তির সংগ্রাম, জাতির পিতার মুখ, শেখ মুজিব, রাজনীতির কবি, পিতার স্থান, একটি কণ্ঠস্বর, মুজিব মিনারে, ৭ই মার্চ, একটি পাইপের আত্মকাহিনির মতো ৪৯ টি কবিতার মাধ্যমে তাঁর ‘রাজনীতির কবি’ কাব্যগ্রন্থটিতে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহাকাব্যিক জীবনের আখ্যান তুলে আনার চেষ্টা করেছেন কবি। নির্দিষ্ট একটি বিষয়কে কবিতায় তুলে আনতে গিয়ে তাঁকে কোথাও কোথাও ছাড় দিতে হয়েছে। তিনি যেমনি একজন সুসাহিত্যিক তেমনি একজন সুবক্তা-ও। শরীয়তপুর জেলার প্রশাসনিক বিভিন্ন দপ্তরে সুবক্তা হিসেবে সরব উপস্থিতি তাঁর। অনেকে বলেন মধুমাস জ্যৈষ্ঠে জন্ম তাই তাঁর কথায় এমন মধু ঝড়ে পড়ে! মানুষকে কথার জাদুতে মোহাচ্ছন্ন করে রাখতে পারাএ এক অনন্য যোগ্যতা তাঁর। যা সকলে পারে না। আমার ভাবনা মতে তিনি প্রচুর পড়াশোনা করেন সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজ সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে। সেখান থেকে আহরিত জ্ঞান তুলে ধরেন তাঁর লেখনিতে এবং সভাসমাবেশে চমৎকার উপস্থাপনার মাধ্যমে। আমি তাঁর সাথে কোনো অনুষ্ঠানে থাকলে অপেক্ষায় থাকি তাঁর মুখরোচক, বিচক্ষণ ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যদি বলি: তুমি কেমন করে কথা কও হে গুনী, আমি মুগ্ধ হয়ে কেবল শুনি, কেবল শুনি... আমার কাছে এমনটাই মনে হয়। পাশাপাশি তিনি একজন সংগঠকও বটে। ‘জাতীয় সাহিত্য ফাউন্ডেশনে’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি। জাতীয় সাহিত্য ফাউন্ডেশন কবি সাহিত্যিকদের বিভিন্ন দাবি আদায়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে চলছে। তাঁর লেখালেখির জন্য ইতিমধ্যে তিনি একাধিক সংবর্ধনা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

শাড়ির পাড়ের মতো উঠানের একপ্রান্তে শুয়ে আছেন তাঁর মা। যখন বেঁচেছিলেন কবিকে আঁচলের গিঁট খুলে কতগুলো কাঁচা পয়সার সাথে অনেকগুলো স্বপ্ন বুক পকেটে পুড়ে দিয়েছিলেন একদিন- এমনটাই লেখা আছে তাঁর কবিতায়। সেই স্বপ্নগুলো সত্যি হয়ে ধরা দিক এক এক করে। পূরণ হোক একটি অমর কবিতা লিখার বাসনা, তাঁর কবিতা উতরে যাক সময়কে। কবির জন্মদিনে এই প্রত্যাশা আমাদের।

লেখক : কবি ও নির্বাহী সম্পাদক, কীর্তিনাশার কাব্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন